মঞ্চ থেকে প্রথা মাফিক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণ শেষ করলেন৷ জনতা ফেটে পড়ল৷ মাইকের সামনে তখন দীর্ঘদেহী মুজিবুর রহমান৷ তিনি এবার ইংরাজিতে বক্তব্য শুরু করলেন– ‘প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতি গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান প্রেজেন্ট…
এরপরেই জনতার প্রবল দাবি– ‘বাংলা…বাংলা’। একটু থেমে গেলেন বঙ্গবন্ধু৷ পাশ থেকে ইন্দিরা মুচকি হেসে জানিয়ে দিলেন ‘বেঙ্গলি…বেঙ্গলি’৷ হাসি খেলে গেল শেখ মুজিবের মুখে৷ নিজের দেশ–বাংলাদেশের তরফে স্বাধীনতার শুভেচ্ছা দিয়েই আপামর ভারতবাসীকে বাংলায় সম্বোধন করলেন বঙ্গবন্ধু৷
দিল্লির সে বিশাল জনসমাগমে বঙ্গবন্ধু বললেন–‘আমার ভাই ও বোনেরা…আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুখী মানুষকে দেখিয়েছে চিরদিন বাংলারমানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের (কারাকক্ষ) মধ্যে বন্দিছিলাম কিছুদিন আগেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন জায়গা নাই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকেরক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার কাছে এবং তার সরকারের কাছেকৃতজ্ঞ। আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি লোকের খাওয়ার বন্দোবস্ত এবংথাকার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন…আমি জানি ভারতবর্ষের মানুষ খুব দুখী আছে সেখানে, তারাও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরও অভাবঅভিযোগ আছে—তা থাকতেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে আমার লোকরে সাহায্য করার জন্য, চিরদিন আমরা তা ভুলতে পারবো না।
বঙ্গবন্ধু বললেন ‘আমরা আশা করি, আপনারা জানেন বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে, আমি সকল প্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি এবং এওআশা করি দুনিয়ার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সাহায্য করার জন্য।
‘আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে।
‘আমাকে প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শে এত মিল কেন? আমি বলি, এটা আদর্শের মিল, এটানীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্ব শান্তির মিল।…’’
এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লীবাসীর উদ্দেশে নিজের ভাষণে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ভারতেরজনগনের মাঝে এসেছেন ইহা ভারতের জন্য আনন্দ ও গৌরবের দিন। তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে মুক্তও নয়া জীবন গঠন করার প্রেরনা দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের দেহ পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিল তার আদর্শ নয়।ইন্দিরা গান্ধী বলেন তিনি তিনটি বিষয়ে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সকল প্রতিশ্রুতি পুরন করেছেন। প্রতিশ্রুতি গুলিহল শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো, মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য এবং শেখ মুজিবকে মুক্ত করা। শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগন ওপরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। শেখ মুজিবকে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ হল সমৃদ্ধি, প্রগতিশীলও শক্তিশালী দেশ গঠন এবং দেশের জনগণকে নবজীবন প্রবাহে উদ্ভুত করা।
উল্লেখ্য, ৮ই জানুয়ারী ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রায়২৪ ঘণ্টা লন্ডনে অবস্থানকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাৎ করেন বঙ্গঁবন্ধু। ৯ জানুয়ারি হিথরো থেকে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে যাত্রা করেন তিনি। পথিমধ্যে ১০ জানুয়ারি তিনি দিল্লির পালামবিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রা বিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী–সহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্য ও শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের জাতির পিতাকে ঐতিহাসিকঅভ্যর্থনা জানান। ২১ বার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়, ওড়ানো হয় বাংলাদেশ ও ভারতেরজাতীয় পতাকা। বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত। এরপর বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হয় রাজসিক সংবর্ধনা।
পরে একই বিমানে চড়ে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশে পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের কারাগারে থেকেও যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের যিনি রাষ্ট্রপতি, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে বাংলার মুক্ত স্বদেশে স্বাগত জানায় লাখো উদ্বেলিত বাঙ্গালী।