১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি হত্যার জীবন্তস্বাক্ষী মো: দেলোয়ার হোসেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে বদরবাহিনীর টর্চার সেল হিসাবে পরিচিত শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সংগঠিত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের একজন প্রত্যক্ষ্যদর্শী তিনি।
তার বর্ননায় উঠে এসেছে ৭১ সালে আলবদর, আলসামস, রাজকাররা কিভাবে বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে।
মো: দেলোয়ার হোসেন বলেন, মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে তখন (বদরবাহিনীর ক্যাম্প) একেকজন করে সবাইকে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হতো। ১৪ ডিসেম্বর দেশেরে বুদ্ধিজীবীদের এখানে ধরে আনা হয়। মো: দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর এ বর্ননায় উঠে এসেছে সেদিন বিকাল ৫টায় বদরবাহিনীর সদস্যরা শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরী, মুফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডা. রাব্বী সহ অনেক সাংবাদিক, শিক্ষককে বদরবাহিনীর সেই ক্যাম্পে তার কক্ষে নিয়ে আসে। এসময় নির্যাতনের কারনে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর হাত বাঁধা ছিল এবং তিনি তীব্র যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেও।
মো: দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাত ৮টার দিকে বদরবাহিনীর সদস্যরা ঐ কক্ষে প্রবেশ করে এবং প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বদরবাহিনীর সমস্যরা মুনির চৌধুরীর কাছে পরিচয় জানতে চাই। পরিচয় পেয়ে তারা মুনির চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর কোন বই লিখেছো?’ মুনির চৌধুরী উত্তরে লিখেনি বলে জানায়। এরপর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে একই প্রশ্ন করেন বদরবাহিনীর এক সদস্য। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর বই লিখেছেন বলে জানায়।’ এরপর জিজ্ঞাসাবাদে একজন নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে এক বদর সদস্য বলেন, তুমি মুক্তিবাহিনীকে ঔষধ সাপ্লাই দিয়েছ, চিকিৎসা করেছ। একই সময় চিৎকার করে অন্য এক বদর সদস্য বলতে থাকেন, শালারা সব ইন্ডিয়ান স্পাই এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পাই। শালারা সব গভর্ণমেন্টের টাকা খেয়ে গাদ্দারী করছে, শালারা সব গাদ্দার।
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালেই একজন পাকিস্তানি সৈন্য ভেতরে প্রবেশ করলো। সে উর্দু ভাষাতে বদর সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন ‘আমাদের হাতে সময় খুব কম, তোমাদের যা করার তারাতারি করো’ এরপর বদর বাহিনীর সদস্যরা মুনির চৌধুরীর দিকে এগিয়ে যায়। বদর বাহিনীর এক সদস্য মুনির চৌধুরীর মাথা সামনে এনে পা দিয়ে চেপে ধরে। অন্যরা লোহার মোটা একটা রড দিয়ে মুনির চৌধুরীকে পেটাতে শুরু করে। একপর্যায়ে মুনির চৌধুরীর মাথায় ঐ লোহার রড দিয়ে আঘাত করার কারনে মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। এসময় তার মুখ দিয়েও গলগল করে রক্ত বের হলেও তিনি ‘লা ইলাহা ইল্লাহু’ কালেমা পড়ে যাচ্ছেন। এরপর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকেও বেদম পিটিয়েছে তারা । এভাবে পুরো কক্ষে ঘন্টাখানেক পিটিয়ে বদর বাহিনীর সদস্যরা ঐ কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। সেদিন ঐ শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের ছাঁদের উপর নারীদের সম্ভবহানীর চিৎকার শুনার কথাও জানায় মো: দেলোয়ার হোসেন।
ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যাওয়া মো: দেলোয়ার হোসেন ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে আরো বলেন, রাত ১২ টার দিকে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের সেই বদরবাহিনীর টর্চার সেল থেকে প্রায় হাজার-বারোশত বন্দী, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতাকামী মানুষকে বের করে মাঠে আনা হয়। বদরবাহিনীর সদস্যরা তখন খোলামাঠে ২৫ থেকে ৩০টি বাস এনে রেখেছিলো। বন্দি সবাইকে ঐ বাসগুলোতে উঠিয়ে রায়েরবাজার নিয়ে যাওয়া হয় সেই ১৪ ডিসেম্বর দিবাগতরাতে।
মো: দেলোয়ার হোসেন বলেন, তখন শীতের রাত ছিলো। রায়েরবাজারে নিয়ে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ৫০-৬০ জন করে বন্দীকে ডোবার পাশে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয়। এরপর সে লাইন থেকে ৮-১০ জন করে বন্দীকে ধরে এনে বদরবাহিনীর সদস্যরা রাইফেলের বেয়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা শুরু করে। এসময় অনেক বন্দী চিৎকার করে বদরবাহিনীর সদস্যদের বলতে থাকে ‘ভাই তোমরা বাঙ্গালী হয়ে আমাদের মারবা কেন? পাকিস্তানি সৈন্যরা যদি আমাদের মারতো তবে দু:খ থাকতো না। তোমাদের যদি টাকার দরকার হয় তবে আমাদের ছেড়ে দাও আমরা ৫০/৬০ হাজার টাকা করে দেব। বদরবাহিনীর সদস্যদের এ কথা যারা বলেছে তাদের সবাইকে সেদিন রাইফেল দিয়ে শুট করে হত্যা করে বদরবাহিনীর সদস্যরা”।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের প্রশাসনিক বিভাগ ও জেলা অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবিদের একটি আনুমানিক তালিকা তৈরি করা হয়। এতে শিক্ষাবিদ – ৯৯১ জন, সাংবাদিক – ১৩ জন, চিকিৎসক – ৪৯জন, আইনজীবী – ৪২ ও অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) – ১৬ জনের তথ্য ছিলো।