মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন–চট্টগ্রাম যুদ্ধ

674

পঁচিশের রাতে সূর্য সেনের স্মৃতিবিজড়িত বীর চট্টলার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। বাঙালি সৈনিকেরা,”রাজনৈতিক ও সগ্রামী কৃষকশ্রমিক, ছাত্র-জনতা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করে। একথা সর্বজনবিদিত যেচট্টগ্রামেই প্রথম বাঙালি সৈনিকেরা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে এবং এখানেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার বাণী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের বীর জনগণের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা হাজার বছরের ইতিহাসে অসীম সাহস, অমিত তেজ ও স্বদেশ প্রেমের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। (চট্টগ্রামের সেনানিবাস এই সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রায় ২,৫০০ বাঙালি সৈনিক অবস্থান করছিল। এই সেন্টারের অধিকাংশ অফিসার ছিলেন বাঙালি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডার ছিলেন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার।

প্রধান প্রশিক্ষক লেঃ কর্নেল এম আর চৌধুরী (শহীদ), ক্যাপ্টেন এম এস এম ভুইয়া, ক্যাপ্টেন এনামুল হক, ক্যাপ্টেন মহসীন ও ক্যাপ্টেন আজিজ প্রমুখ বাঙালি অফিসারগণ সে সময় চট্টগ্রামে ছিলেন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মােল শহরে অবস্থান করেছিল এই বাঙালি ব্যাটালিয়ানটি মার্চের প্রথমদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা ছিল। মার্চের প্রথম সপ্তাহে একটি কোম্পানী দু’জন পাকিস্তানী অফিসারসহ পশ্চিম পাকিস্তানের খরিয়ান সেনানিবাসে চলে যায়। রাকি তিনটি কোম্পানী পঁচিশে মার্চ রাতে যােল শহরে অৱস্থান করছিল।এই ব্যাটালিয়ানে মাত্র ১২টিকা মেশিনগান, প্রায় ৩৩ ইঞ্চিরাইফেলসত্র চার পাঁচটি গাড়ি ছিল। এই ব্যাটেলিয়নের কমাণ্ডিং অফিসারগণ কর্মরত ছিলেন।

দামপাড়া এমবারকেশন হেড কোয়ার্টারে বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনের অধীনে আটনিয়জন বাঙালি সৈনিক ছিলেন। ডবলমুরিং-এ অবস্থিত আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্পের অধিনায়ক লেঃ বেলায়েত হােসেন অবাঙালি হলেও এখানকার অধিকাংশ সৈনিক ছিলেন বাঙালি। | অপরদিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পাকিস্তানী বাহিনীর ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের প্রায় ৪০০ সৈন্য ২৯ ক্যাভারীর ট্যাংক টুলস, মেডিক্যাল কো, ইনফেরি ওয়ার্কশপ ও সাপ্লাই ডিপাের সৈন্যরা অবস্থান করছিল। এদের মধ্যে কিছু বাঙালি অফিসার ও সৈনিক ছিল। চট্টগ্রাম হালিশহরে ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর)-এর সদর দফতর অবস্থিত ছিল। এই সেক্টরের অধীনে তিনটি উইং ছিল। ১১ নং উইং-এর অবস্থান ছিল কাপ্তাই-এ। সেক্টর কমাণ্ডার ছিল পাকিস্তানী অফিসার লেঃ কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ। পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার মেজর হামিদ ছিলেন উপ-অধিনায়ক। বাঙালি অফিসারদের মধ্যে ছিলেন সেক্টর এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ১৭ নং উইং-এর সহকারী উইং কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন , হারুন আহমেদ চৌধুরী, ১৪ নং উইং কমাণ্ডার মেজর শামসুদ্দিন ও মেডিক্যাল অফিসার মেজর আমিরুল ইসলাম, ১৭ নং উইং-এর অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তানী অফিসার মেজর পীর মােহাম্মদ এবং ১১ নং উইং-এর অধিনায়ক ও সহকারী অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে মেজর ইকবাল ও ক্যাপ্টেন হায়াত। এই সেক্টরে মােট সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই সহস্রাধিক যার মধ্যে ৪০০ জন ছিল পশ্চিমপাকিস্তানী। এই ৪০০ জন পশ্চিম পাকিস্তানীর মধ্যে ১০০ জন ছুটি ভােগ করছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। অপরদিকে ১৬০০ বাঙালি সৈন্যের মধ্যে ১০০ জন ছুটিতে ছিল। সুতরাং প্রায় ১৫০০ বাঙালি সৈন্য এখানে ছিল ২৫শে মার্চে। অপরদিকে ৩০০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাদেক উপত্যকায় ও টানডং-এর ১৪ নং উইং-এর এক কোম্পানী অবস্থান করছিল। রামগড় ও উইং সদর দফতরে এক কোম্পানী সৈন্য ছিল। অপরদিকে। ১১ নং উইং-এর কোম্পানীগুলি কক্সবাজার, টেকনাফ, বরকল, মাসলং এবং উইং সদর দফতরে অবস্থিত ছিল। ) ক বিরাজমান রাজনৈৰ্তিক অস্থিরতা ও বিদ্রোহ দমনের জন্য মার্চ মাসের প্রথম থেকেই ইপিআর বাহিনীকে পাঁচলাইশ, রেলওয়ে স্টেশন, অয়ারলেস কলােনী, আমবাগান কলােনী, পাহাড়তলি রেলওয়ে স্কুল ওয়ার্কশপ, ভিক্টোরিয়া জুট মিল, আমিন জুট মিল, হালিশহর অবাঙালি কলােনী, এয়ারপাের্ট, ফিরােজশাহ কলােনী, সার্কিট হাউজ ও স্টেডিয়াম ইত্যাদি এলাকাতে মােতায়েন করা হয়েছিল। দুটি কোম্পানীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল।)  পেঁচিশে মার্চ বিকেলে চট্টগ্রাম শহরে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীতে মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠকের ব্যর্থতার সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে শংকিত ও প্রতিরােধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত জনতার মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল। এর আগে ২১শে মার্চ জেনারেল হামিদ চট্টগ্রাম নিবাস পরিদর্শনে এসেছিলেন। এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ভােজসভায় জেনারেল হামিদ ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফাহমীরকে এক প্রান্তে ডেকে বললেন, ফাহমী, সংক্ষেপে ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সম্ভব লােক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের উপ অধিনায়ক মেজর জিয়া এই কথাগুলাে শুনে ফেলেন। এই প্রসঙ্গে মেজর জিয়া সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন যে, ১৭ই মার্চ স্টেডিয়ামে মেজর জিয়া লেঃ কর্নেল এম আর চৌধুরী(শহীদ), মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন ওলি আহমেদ সম্ভাব্য প্রতিরােধের পরিকল্পনা করেছিলেন।

এর দুদিন পরে ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন রফিক মেজর জিয়ার বাসায় এলে তার সাথে বিস্তারিত আলােচনা হয় এবং ইপিআর বাহিনীকে সতর্ক রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ২৪শে মার্চ জয়দেবপুর সেনানিবাসে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে আয়ত্তে রাখার অজুহাতে পাপা টাইগার ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে পাকিস্তানীরা ঢাকা নিয়ে যায়। তিনি আর চট্টগ্রামে ফিরতে পারেননি।)  চট্টগ্রামে সেদিন (২৫শে মার্চ) ৪.৩০ মিনিটে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ জাফর ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে দেখা করে বিস্তারিত আলােচনা করেন। রাত ৮.৩০ মিনিটের সময় ডাঃ জাফর আবার ফিরে এসে জানালেন যে, ঢাকায় রাজনৈতিক আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং ইয়াহিয়া গােপনে করাচী চলে গেছেন। ঢাকা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহরে বেরিয়ে পড়েছে বলে শােনা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তখন জনাব এম আর সিদ্দিকীর বাসায় এক রুদ্ধদার বৈঠকে মিলিত হয়েছে। ক্যাপ্টেন রফিক তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। খাওয়া ছেড়ে তিনি হালিশহরে ইপিআর সদর দফতরে ফোন করে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দেন এবং অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আদেশ দেন। নৌবাহিনী সদর দফতরের দিক থেকে হামলা হতে পারে ভেবে সেদিকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন রফিক ডাঃ জাফরকে ষােলশহর ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত সমস্ত বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ করার জন্য মেজর জিয়া ও লেঃ কর্নেল এম আর চৌধুরীর সাথে যােগাযােগ করতে বললেন।
প্রায় ১০০ সৈন্য আগ্রাবাদ রােভাও গুরুত্বপূর্ণ মােড়ে মােতায়েন করা হল। রামগড় থেকে আগমনরত সৈন্যদেরকে ফেনী নদীর উপর শুভপুর সেতু ধ্বংস করে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেয়া হয়। ২৫শে মার্চ রাত প্রায় এগারােটার সময় ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয় ট্রাক সৈন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অস্ত্রাগারের সামনে এসে দাঁড়াল।

অতর্কিতভাবে অস্ত্রাগার প্রহরারত বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করে তারা অস্ত্রাগার দখল করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের চারদিক ঘিরে ফেলল। তারপর পাকিস্তানী হায়েনার দল শুরু করল পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। মেশিনগান ও মর্টারের অবিরাম গােলাবর্ষণে আকাশ-বাতাস প্রকম্বিত হল। ব্যারাকে ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্য ও রিকুটসহ প্রায় এক হাজার বাঙালি সৈনিক প্রাণ হারাল। চট্টগ্রাম সেনানিবাস পাকসেনাদের পাশবিকতায় নরক কুণ্ডে পরিণত হল। এই হত্যাকাণ্ড মামলাই অথবা জালিয়ানওয়ালাগের হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতাকে হার মানাল। তাদের হাত থেকে বাঙালি সৈনিকদের পরিবারবর্গও রক্ষা পেল না। কয়েকজন সৈন্য কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ষােলশহরে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলে এসে পাকসেনাদের বর্বরােচিত আক্রমণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয় এবং সেই রাতের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের কাছে চট্টগ্রামের সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের প্রাণ বাঁচানাের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে।

সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল মেজর জিয়ার নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল সাহায্যে এগিয়ে যাবে। কিন্তু মেজর জিয়া সেই মুহূর্তে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল বাঙালি সৈনিকদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারলেন না। পরবর্তীকালে অষ্টম বেঙ্গলের তরুণ অফিসারেরা বলেন যে, মাত্র ২০০ সৈন্য, ৩০৩ ইঞ্চি রাইফেল ও সামান্য গােলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাস আক্রমণ করা আত্মহত্যার সামিল হত। এই প্রসঙ্গে অনেকের ধারণা, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যদের যদি সেই ভয়াবহ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিক ও তাঁদের পরিবারবর্গের রক্ষার জন্য পাঠানাে হত তাহলে অনেক বাঙালি সৈনিক প্রাণে রক্ষা পেতেন। তাদের মতে শুধুমাত্র যদি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কাছে পাহাড়ের ওপর থেকে বেলুচ রেজিমেন্টের ওপর গােলাবর্ষণ করা হত তাহলেও অনেক বাঙালি সৈন্য পালাতে সক্ষম হত। মেজর জিয়া তার সৈন্যদের নিয়ে শেষ রাতের দিকে ষােলশহর ছেড়ে কালুঘাটের দিকে চলে যান। ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে যখন চট্টগ্রাম শহরে ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকেরা মরণপণ লড়াই-এ নিয়ােজিত তখন মেজর জিয়া তার সৈন্যদের নিয়ে কালুরঘাটে অবস্থান করছিল। এর ফলে কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, রামগর, বরকল ইত্যাদি সীমান্ত এলাকা থেকে আগত ইপিআর সৈনিকদের কালুরঘাটে থামিয়ে দিয়ে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আনা হয়। এরা চট্টগ্রাম শহরে এসে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে মিলিত হতে পারেননি।  ২৬শে মার্চ সকালে ১৭ নং উইং-এর সহকারী উইং কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন হারুন তার ইপিআর বাহিনী নিয়ে কালুরঘাটে পৌছান এবং মেজর জিয়ার সাথে যােগ দেন। মেজর জিয়া অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলে ও ইপিআর-এর সৈনিকবৃন্দ ও আনসার মুজাহিদ ছাত্র ও রিক্রুটদের নিয়ে একটি যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। পরিস্থিতি অনুসারে মেজর জিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপঃ ১। এক কোম্পানী চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণ করবে। অধিনায়ক ও মেজর মীর শওকত আলী ২। এক কোম্পানী সীতাকুণ্ডে পাকসেনাদের গতিরােধ করবে  অধিনায়ক।

রাত তখন আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ক্যাপ্টেন রফিক তাঁর দু’জন সশস্ত্র গার্ড এবং ড্রাইভার কামালকে সঙ্গে নিয়ে সারসন রােড থেকে অয়ারলেস কলােনীর দিকে অগ্রসর হলেন। ক্যাপ্টেন হায়াত (পাকিস্তানী) একটি প্লাটুনসহ এখানে অবস্থান করছিলেন। ক্যাপ্টেন রফিক বিনা রক্তপাতে নিঃশব্দে সকল পাকিস্তানীদের বন্দি করতে চেয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন রফিক ক্যাপ্টেন হায়াতের কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ক্যাপটেন হায়াত তখন সবেমাত্র ঘুমিয়েছেন। ক্যাপ্টেন রফিক মুহূর্তকাল পরে তার কক্ষে করাঘাত করলেন। ক্যাপ্টেন হায়াত দরজা খুললেন। ক্যাপ্টেন রফিক জিজ্ঞেস করলেন, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তাে? কথা শেষ হতে না হতেই ক্যাপ্টেন রফিক তার বুকে স্টেনগান ধরে তাকে গ্রেফতার করেন। ক্যাপ্টেন হায়াত তার জামার পকেট থেকে পিস্তল বের করবার। চেষ্টা করলে ক্যাপটেন রফিকের দেহরক্ষী তার রাইফেল দিয়ে হায়াতকে আঘাত করেন। হায়াত বন্দি হলেন। ক্যাপটেন রফিক প্লাটুনটির আর তিনজন পাকিস্তানীকে বন্দি করে বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার উদাত্ত আহ্বান জানালেন। বাঙালি সৈনিকেরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল এবং নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। ক্যাপ্টেন রফিক ৯.১০ মিনিটে হালিশহর সদর দফতরে যাত্রা শুরু করেন।

রাত ৯.৩০ মিনিটে তিনি হালিশহরে এসে পৌঁছেন। তিনটি অস্ত্রাগারই নির্দেশ মােতাবেক আগে থেকেই বাঙালি সৈনিকেরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। সমস্ত বাঙালি সৈনিকেরা ক্যাপ্টেন রফিকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাঙালি সৈনিকেরা যার যার অস্ত্রাগারের সামনে সমবেত হয়েছিল। মাসখানেক আগে প্রাপ্ত ৩০৩ ইঞ্চি রাইফেল ও পর্যাপ্ত গােলাবারুদের জন্য সৈনিকদের মনােবল বেড়ে গিয়েছিল। হালিশহর সদর দফতরে প্রায় ৩০০ পাক ইপিআর সৈন্য ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল জেসিও এবং এনসিও। সদর দফতরের চারদিকে অবাঙালিদের ঘনবসতি ছিল। এইসব অবাঙালিদের মধ্যে কিছু পাককমাণ্ডে অবস্থান করছিল। কমাণ্ডোসহ অবাঙালিরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। গােলাগুলির শব্দ সব পরিকল্পনা পণ্ড করে দিতে পারত। এছাড়া গােপনীয়তা রক্ষা করতে না পারলে নৌবাহিনী সদর দফতর থেকে পাকবাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দুই প্লাটুন সৈন্য মােতায়েন করা হল। ক্যাপ্টেন রফিক অফিস কক্ষের সামনে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগলেন। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তানী সুবেদার মেজর সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। গণহত্যা পরিকল্পনা কঠোরভাবে গােপনীয়তা রক্ষা করার জন্য সিনিয়র অফিসার ছাড়া সাধারণ সৈনিকেরা এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। পাশের কক্ষ থেকে চারজন সশস্ত্র বাঙালি সৈনিক এসে সুবেদার মেজরকে গ্রেফতার করলেন। সিগনাল কোম্পানীর দায়িত্বে নিয়ােজিত পাকিস্তানী সুবেদার মােমিন অফিস কক্ষের ভেতর এলে তাকেও গ্রেফতার করা হল।

এইভাবে ১০.৪৫ মিনিটের মধ্যে সকল অবাঙালি ইপিআর সৈন্যদের বন্দি করা হল। ক্যাপ্টেন রফিকের নির্দেশ মােতাবেক চট্টগ্রাম শহরের সীমান্ত ফাঁড়িগুলাের সকল পাক-সৈন্যদের বন্দি করা হয়। ২৫শে মার্চের রাতেই অনেক বাঙালি ইপিআর সৈন্য সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে চট্টগ্রামের পথে যাত্রা শুরু করে। চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত বাঙালি ইপিআর সৈনিকেরা অমিততেজে চুড়ান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিল। শুধুমাত্র বিমান বন্দরে মােতায়েন প্লাটুনটিকে নৌবাহিনীর সদর দফতরের সৈন্যরা গ্রেফতার করে বিমান বন্দর দখল করে ফেলে।

ক্যাপ্টেন রফিক শক্রর অগ্রাভিযান রােধ করার জন্য উপকূলীয় বাঁধ বরাবর দুই প্লাটুন সৈন্য মােতায়েত করলেন। এক কোম্পানী রেলওয়েতে ছিল ও ছােট ছােট দলে ভাগ করে ক্যাপ্টেন সাদেক ৩। এক কোম্পানী মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় থাকবে। অধিনায়কঃ লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরী ৪। এক কোম্পানী চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায় থাকবে। অধিনায়ক ও ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী ৫। এক কোম্পানী কালুরঘাট এবং বেতার কেন্দ্র এলাকায় থাকবে। অধিনায়ক ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী ৬। এক কোম্পানী। কালুরঘাট রিজার্ভ হিসেবে থাকবে। অধিনায়ক ও লেঃ মাহফুজুর রহমান।

ক্যাপ্টেন অলি আহমেদকে কালুরঘাটে সদর দফতরে কো-অর্ডিনেটিং অফিসার নিয়ােগ করা হয়। ক্যাপ্টেন রফিক যুদ্ধরত ইপিআর বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য মেজর জিয়াকে অনুরােধ জানালেন। মেজর জিয়াকে শহরে ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও চেষ্টা করেছিলেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব হান্নান ভাের পাঁচটায় বেরুলেন শহরের সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখার জন্য। আর থানার সামনে এসে দেখলেন কিছু লােক দাড়িয়ে আছে। কারাে কারাে হাতে রাইফেল। তাদের কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে জনাব হান্নান কালুরঘাটে গেলেন। অনেক চেষ্টার পরে গােছমণ্ডি স্টেশনের কাছে মেজর শওকত ক্যাপ্টেন অলি ও অন্যান্যদের দেখা পেলেন। মেজর জিয়া তার সেনাদলকে সংগঠিত করে ফিরে আসবেন আশ্বাস দিলেন। কিন্তু এর পরে মেজর জিয়া আর শহরে ফিরে আসতে পারেননি।  প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, মেজর জিয়া চট্টগ্রাম এলাকার জীবিত অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়ার ছিলেন। ক্যাপ্টেন রফিক সেই কারণেই আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে মেজর জিয়ার সাথে যােগাযােগ করতে বললেন। সংগ্রামরত সৈন্যদের পক্ষে বেতারে কিছু বলার জন্য অনুরােধ করা হয়। অনুরুদ্ধ হয়ে ২৭ শে মার্চ বিকেলে তিনি কালুরঘাটস্থ বেতারকেন্দ্রে আসেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে তিনি এক ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বলে ঘােষণা করেন। এই ঘােষণার ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এম আর সিদ্দিকী বললেন, এই ঘােষণা আন্দোলনের চরিত্রকে বিপন্ন করবে। জনগণের অভ্যুত্থানবলে, এক সামরিক অভ্যুত্থানবলে মেজর জিয়ার কাছে গেলেন। মেজর জিয়া এক সংশােধিত ভাষণে জাতির নেতা শেখ মুজিবের পক্ষে এই ঘােষণা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে ঘােষণা করেন।

কালুরঘাটে অবস্থিত স্বাধীন বেতারকেন্দ্রটি প্রহরা দিচ্ছিল ইপিআর সৈনিকরা। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কিছু বাঙালি কারিগর ও অন্যান্য কুশলী কর্মচারিগণ বেতার কেন্দ্রটি পরিচালনা করছিলেন। বেতারকেন্দ্রটির কর্মসূচী প্রচার বা নিয়ন্ত্রণ করার মতাে প্রয়ােজনীয় প্রশাসনের অনুপস্থিতির ফলে যে কোন অতি উৎসাহী ব্যক্তি বক্তৃতা দিতে পারতেন।

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘােষণাপত্র পাঠ নিয়ে বেশ বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ অনুরুদ্ধ হয়ে বেতারকেন্দ্রে যান। বেতারকেন্দ্রের কর্মচারী মেজর জিয়াকে পেয়ে আনন্দিত হন। বেতার কর্মীরা বার বার ঘােষণা দিচ্ছিলেন আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু মেজর জিয়া পনের মিনিটে তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। এই পরিস্থিতিতে লেখার ঝুঁকিও ছিল অনেক। তাছাড়া ওই সময়ে দেড়ঘণ্টা মুসাবিদার পর তিনি ইংরেজীতে ও বাংলায় বিবৃতিটি পাঠ করেন। লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরী ২৮শে মার্চ সারাদিন বেতারকেন্দ্র থেকে ঐ বিবৃতি পড়েছিলেন।

জনাব মাহবুব-উল আলম তার রক্ত আগুন স্বাধীনতায়’ গ্রন্থে লিখেছেন মেজর জিয়ার বেতার ভাষণের আগেই আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ঘােষণা ব্যাপকভাবে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রচারের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। সে অনুযায়ী ডাঃ জাফর স্বাধীনতার ঘােষণা পত্রের খসড়া তৈরি করেন। সেই ঘােষণাপত্র কিঞ্চিত সংশােধন করে সেদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ বেলা আড়াইটার সময় জনাব হান্নান সর্বপ্রথম ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। সেইদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতারের বর্ষীয়ান গীতিকার, কবি আবদুস সালামও স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়ে ভাষণ দেন। কে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেছিলেন সে বিতর্কে না গিয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায় মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর ও আহ্বানে বাঙালি সৈনিক ও জনতাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাড়া জাগিয়েছিল। এই ঘােষণার ফলেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে যে বাঙালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছে।

২৫শে মার্চ রাতে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের ডিউটি অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ। কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল আব্দুল রশীদ জানজুয়ার নির্দেশে মেজর মীর শওকত আলী ‘সি’ কোম্পাণীসহ সন্ধ্যায় বন্দরের দিকে রওনা হলেন। লেঃ কর্নেল জানজুয়াও সঙ্গে রইলেন। নটার দিকে মেজর শওকত বন্দরে পৌছলে তার কোম্পানীকে মিলিটারী ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হল। বন্দরের ১৭ নং জেটিতে অবস্থানরত বিগ্রেডিয়ার আনসারীর সঙ্গে লেঃ কর্নেল জানজুয়া কথা বললেন। কথা শেষ করে জানজুয়া মেজর জিয়াকে বন্দরে চলে আসতে নির্দেশ দিলেন। জানজুয়া রাত দশটার দিকে কোম্পানী রেখে শুধু মাত্র মেজর শওকতকে সঙ্গে নিয়ে একটি নৌবাহিনীর ট্রাকে ৫/৬ জন অবাঙালি সৈন্যসহ ষােলশহরে চলে আসেন। মেজর শওকত সেনাদলের সঙ্গে থাকতে চাইলেও তাকে এক রকম জোর করেই মােলশহরে নিয়ে যাওয়া হল। মােলশহরে পৌছে লেঃ কর্নেল জানজুয়া মেজর জিয়াকে নৌবাহিনীর ট্রাকেই বন্দরে যেতে বললেন। অপরদিকে ‘ডি’ কোম্পানী নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে মিলিটারী টানজিট ক্যাম্পে যেতে নির্দেশ দিলেন।

এমন সময় ডিউটি রুমের টেলিফোনটি বেজে উঠল। ক্যাপ্টেন দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন। টেলিফোনের অপর প্রান্তে স্ট্যান্ডার্ড বাংকের ম্যানেজার জনাব আবদুল কাদের। জনাব কাদের ঢাকায় পাকিস্তানী বর্বতার কথা জানিয়ে সাবধান হতে উপদেশ দিলেন। ক্যাপটেন অলি টেলিফোন রেখে দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে দেখলেন মেজর জিয়া, মেজর শওকত ও লেঃ কর্নেল জানজুয়া তখনও আলাপ করছেন। ক্যাপ্টেন অলি ইশারায় দু’হাত জোড় করে বন্দি অবস্থায় কথা জানালেন। কিন্তু কোন কথা বলার আগেই জানজুয়া মেজর জিয়াকে গাড়িতে তুলে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দিলেন এবং মেজর শওকতকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলেন। কিন্তু শওকত অফিসার মেসে তার কক্ষে এলেন।

কিছুক্ষণ পরই লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরী ক্যাপ্টেন অলিকে ফোন করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ভীষণ গােলাগুলির খবর দিলেন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার কোম্পানী নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন অলি তখনই টেলিফোনে মেজর শওকতকে সব জানালেন। মেজর শওকত চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ২০ বেলুচের বাঙালি সৈন্যদের আক্রমণ ও ঢাকায় পাকিস্তানী বর্বরতার কথা জানতে পেরে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে তার কোম্পানী নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে যেতে নিষেধ করলেন। চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানরত লেঃ মাহফুজ ও লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরীকে সৈন্যসহ ষােলশহর ফিরে আসতে বললেন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে পাঠালেন মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনতে। মেজর জিয়া তার কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়ার আদেশ মােতাবেক বন্দরের দিকে যাচ্ছিলেন। মেজর জিয়াকে চট্টগ্রাম এমভি সােয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আনার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছিল। রাস্তায় ব্যারিকেডের জন্য মেজর জিয়া অগ্রসর হতে পারছিলেন না। খালেকুজ্জামান আগ্রাবাদে পৌছে দেখলেন মেজর জিয়া সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য ব্যারিকেড পরিস্কার করছেন। খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে এক প্রান্তে ডেকে সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানালেন। মেজর জিয়া আর বন্দরে না গিয়ে যােলশহরে ফিরে এলেন এবং লেঃ কর্নেল জানজুয়া সহ অবাঙালি অফিসারদের গ্রেফতার করেন। ঐ রাতেই জিয়া ষােলশহর এলাকা ছেড়ে কালুর ঘাটের দিকে রওনা হলেন।

২৬শে মার্চ রাত দশটায় নৌবাহিনী সদর দপ্তর থেকে এক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য হালিশহরের ইপিআর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। সারারাত ধরে এই যুদ্ধ চলে। ইপিআর সৈনিকেরা বীর বীক্রমে পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণের মােকাবিলা করে এবং শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এই সময় জানা গেল ৮০ থেকে ১০০ টি গাড়ির সৈন্যবাহিনীর একটি কনভয় চট্টগ্রামে অবস্থিত পাকসেনাদের সাহায্যার্থে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করেছে। ২৪শে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি গ্রুপ ও ১২০ মিলি মিটার মর্টার দল ফিড ব্যবহারে এই কলামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কুমিল্লাস্থ ৫৩ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব আনুমানিক একশত মাইল। পথিমধ্যে অনেক কালভার্ট ও ছােট ছােট ব্রিজ ছিল। জনসাধারণ এইসব কালভার্ট ও ব্রীজ ভেঙ্গে দেয়ায় পাকিস্তানী কলামটি দ্রুত অগ্রসর হতে পারছিল না। ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের সৈন্যরা ভাঙ্গা ব্রিজগুলাে মেরামত করছিল।  ফেনী নদীর উপরে শুভপুর ব্রিজ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না করা গেলেও এর বিপুল ক্ষতি সাধন করা হয়। এই ব্রিজ মেরামত করতে সময় লাগবে ভেবে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি পদাতিক বাহিনী নিয়ে নদী অতিক্রম করে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করে। ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার দল ও ১২০ মিলিমিটার দল পেছনে পড়ে রইল এবং ইঞ্জিনিয়ার দল শুভপুর ব্রিজ মেরামত করার কজে ব্যস্ত রইল। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ১৪ মাইল দূরে কুমিল্লায় পৌছে গেলেন তার বাহিনীসহ।  কুমিল্লায় ইপিআর সৈনিকরা রাস্তার পূর্ব পাশের উঁচু জায়গা থেকে পাকবাহিনীকে এ্যামবুসে প্রায় ৭০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল শাহপুর খান নিহত হন। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি পাহাড়ের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন।

প্রায় এক ঘন্টা ধরে এই ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রাথমিক পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধ সম্ভবত এই প্রথম। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী যখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত তখন পাকিস্তানী মর্টারদল শুভপুর ব্রিজ অতিক্রম করে কুমিল্লা পৌছায়। চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে ঢাকায় ৯৪ ডিভিশনের কর্নেল স্টাফকে জরুরি ভিত্তিক সৈন্য পাঠানাের জন্য বার্তা পাঠানাে হয়। পরদিন ২৭শে মার্চ বেলা ন’টার দিকে চট্টগ্রামের আকাশে নিরাপদ উচ্চতায় হেলিকপ্টার উড়তে দেখা গেল। বিমান বাহিনীর সি-১৩০ বিমানে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পাকিস্তানী সৈন্য অবতরণ করতে লাগল। বিমানবন্দর আগে থেকেই পাকিস্তানীদের আয়ত্তে ছিল বলে কিছুই করার ছিল না। ইতিমধ্যে ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ট্যাংকসহ ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে যাত্রা শুরু করল। বিমানবন্দর থেকে পাকসেনারা আগ্রাবাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটি কলাম ২০ বেলুচের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন এবং অন্য একটি দলকে উপকূল বাঁধের উপর অবস্থানরত ইপিআর সৈন্যদের মােকাবেলা করার নির্দেশ দেন।  যুদ্ধরত ইপিআর বাহিনীর গােলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া গােলাবারুদ সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রাম রওনা হন। পাকিস্তানী বাহিনীর অব্যাহত চাপের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা তিন মাইল পেছনে এসে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। ২৮শে মার্চ সকালে পাকবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ও নৌবাহিনীর মধ্যবর্তী প্রধান সড়ক টাইগার পাশ এলাকা দখল করে নেয়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস পাকবাহিনী দখল করে নেয়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাকবাহিনী তাদের দপ্তর স্থাপন করে। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, দামপাড়া পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশেরাও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। চট্টগ্রামে বহু বাঙালি পুলিশ নিহত হয়।

২৯শে মার্চ পাকসেনারা আগ্রাবাদ রােড অতিক্রম করে মাদার বাড়ি ও আইচ ফ্যাক্টরী সড়ক হয়ে নিউমার্কেটের দিকে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। পাকবাহিনীর একটি দল। স্টেডিয়ামের সন্নিকটে নেভাল হাউস থেকে ডিসি হিলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৩০শে মার্চ ইপিআর-এর একটি প্লাটুন কোতয়ালী এলাকাতে পাকিস্তানী কমান্ডের একটি অবস্থানের উপর অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে ১২ জন পাকসেনা হত্যা করে। ঐদিন বিকালে শত্রুর বিমান আক্রমণে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।  ৩১শে মার্চ সকালে পাকবাহিনীর ব্রিগেড আর্টিলারী ট্যাংকসহ ইপিআর ব্যুহ ভেদ করে হালিশহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক জঙ্গী বিমান, আর্টিলারী ট্যাংক, যুদ্ধ জাহাজ বাবর ও এন এস জাহাঙ্গীর পশ্চিম, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিক থেকে অবিরাম আঘাত হানতে থাকে। সকাল ৭টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এই তুমুল সংঘর্ষ চলে। মুক্তিযােদ্ধাদের টিকে থাকার সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই যুদ্ধে চট্টগ্রাম রিজার্ভ পুলিশ লাল খান বাজার পুলিশ লাইনের পুলিশেরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১লা এপ্রিল থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর খন্ডযুদ্ধ চলে। ৬ই এপ্রিল চকবাজার এলাকায় ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী ও লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরী পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন কিন্তু পাকবাহিনীর ক্রমাগত অগ্রাভিযানের ফলে তারা পিছনে চলে আসেন। ৭ই এপ্রিল নাজিরহাট শিয়াল বুককাতে ইপিআর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল আব্দুল আজিজ শেখ মেজর ইকবালসহ ১৮ জনের পাকবাহিনীর একটি দল বাঙালি ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে আসে। ৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী কালুরঘাট বেতারকন্দ্র আক্রমণ করে। ৯ই এপ্রিল মেজর শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাকসৈন্যদের আক্রমণ করে। ১১ই এপ্রিল কালুরঘাট যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধে দেশমাতৃকার অনেক সাহসী যােদ্ধা প্রাণ হারান। ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী গুরুতরভাবে আহত হন এবং চিকিৎসার জন্য তাকে বার্মায় পাঠানাে হয়। লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরী মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় পাকিস্তানীদের হাতে বন্দি হন। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশি তখন প্রচন্ড তান্ডবে কূলে আছড়ে পড়ছিল। চট্টগ্রামের আকাশ তখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস। বন্দর নগরীর শংকিত জনপদ ভীত সন্ত্রস্তভাবে গৃহে অন্তরীণ হয়ে রইল। সহস্ত্র নিরাপরাধ নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারাল। পাকসেনারা বিজাতীয় আক্রোশ ও হিংস্রতায় টহল দিতে লাগল। সমস্ত চট্টগ্রাম তখন একটি প্রেতপুরীর মতাে মনে হচ্ছিল।

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত