মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে নারীর ভূমিকা

510

লেখক: শান্তা পত্রনবীশ
সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্র থেকে ধারনকৃত দৃশ্য

পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় প্রায় সর্বক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানি শাসনকালে জাতিগত নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির জাগরণের যে দিন এসেছিল তার মূলে ছিল সংস্কৃতি সচেতনতা। পূর্ব বাংলায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, অন্তিমে একে অন্যকে প্রেরণা যুগিয়েছে। যে কারণে একটা সময় দেখা যায় যে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে প্রধানত বাংলাদেশের বাইরে ভারতের বিভিন্ন শহর ও সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত শরণার্থী ক্যাম্পে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্বে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়েই নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ্যযোগ্য। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ক্রম-বর্ণনা উপস্থাপন করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা। বেতারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও প্রচণ্ডতম শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের পাশপাশি এই শব্দযোদ্ধাদের কণ্ঠ যুদ্ধ করে গেছে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত। শব্দকে হাতিয়ার করে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের অস্ত্র ছিল কণ্ঠ, গান আর বাদ্যযন্ত্র। এই বেতার কেন্দ্রটির সূচনালগ্ন থেকেই এর সাথে নারীর সম্পৃক্ততা ছিল। বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ডা. মঞ্জুলা আনোয়ার, কাজী হোসনে আরা এবং বেগম মুশতারী শফী।

‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্র থেকে ধারনকৃত দৃশ্য

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, বর্বরতার করুণ চিত্রসহ যুদ্ধকালীন সার্বিক পরিস্থিতি এবং যুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া এই সকল বিষয় দেশবাসীকে জানাতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠকগণ দৃঢ় চিত্তে একনিষ্ঠভাবে এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন, এই দায়িত্ব পালনে সমঅংশীদার ছিলেন নারীরা। সংবাদ পাঠের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন নাসরীন আহমাদ (জেরীন আহমাদ), মিসেস টি হোসেন (পারভীন), দীপ্তি লোহানী, তাজিন শাহনাজ মুরশিদ এবং সংবাদ পর্যালোচনা পাঠ করতেন শেফালী দাস। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দ্রুত একটি পূর্ণাঙ্গ বেতারে রূপান্তরিত হয়েছিল তাই সময় বৃদ্ধি করে নাটক প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জনপ্রিয় একটি ধারাবাহিক নাটিকা ছিল ‘জল্লাদের দরবার’। এখানে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অমানবিক চরিত্র ও পাশবিক আচরণকে তুলে ধরা হতো। এই ব্যাঙ্গাত্মক সিরিজে তাকে কেল্লা ফতেহ খান চরিত্রে চিত্রিত করা হয়। অপর দুটি জীবন্তিকার শিরোনাম ছিল ‘জনতার আদালত’ ও ‘মীর জাফরের রোজনামচা’। নাট্যশিল্পী হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন বুলবুল মহলানবীশ, অমিতা বসু, আলেয়া ফেরদৌসী, মাধুরী চ্যাটার্জী, শিল্পী মহলানবীশ, সুমিতা দেবী, নন্দিতা চট্টোপাধ্যায়, শুক্তি মহলানবীশ, সুফিয়া খাতুন, দিলশাদ বেগম, তাজিন শাহনাজ মুরশিদ, উম্মে কুলসুম, করুণা রায়, মাসুদা নবী, রুনু আহমেদ, কাকিয়া বসু, মালা চৌধুরী।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথিকা রচনা ও পাঠের সাথেও নারীদের সম্পৃক্ততা ছিল। বেতার কেন্দ্রের শুরুর দিকে প্রতি সোমবার সকাল ৭.৩৫ মিনিটে প্রচারিত হতো ‘রণাঙ্গনে বাংলার নারী’ ও সোমবার ছাড়া প্রতিদিন একই সময়ে ‘মুক্তিসংগ্রামে মায়ের ভূমিকা’ শীর্ষক কথিকা। পরবর্তী সময়ে এটি পরিবর্তিত হয়ে সকাল ৭.৪০ মিনিটে ৭ মিনিট ব্যাপী ‘দেশগঠনে নারীর ভূমিকা’ নামে কথিকা পাঠ করা হতো। কথিকা রচনা ও পাঠে সম্পৃক্ত ছিলেন উম্মে কুলসুম (বেগম মুশতারী শফী), জেবুন্নাহার আইভি (আইভি রহমান), বদরুন্নেসা আহমদ, মেহের খন্দকার (সেলিনা খন্দকার), দীপা ব্যানার্জী, শুভ্রা চৌধুরী, পারভীন আক্তার (বুলা মাহমুদ), কুলসুম আজাদ, জলি জাহানুর, বাসনা গুণ, নূরজাহান মাজহার, ডলি নাথ, দীপ্তি লোহানী, নুরুন নাহার জাহুর, রাফিয়া আখতার ডলি, ড. মাহমুদা খাতুন, রেবা আখতার, ড. সুলতানা সারোয়ার জামান। ১৯৭১ সালের ১৩ অগাস্ট জেবুন্নাহার আইভি তার রচিত ও পঠিত কথিকায় ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। ২১ অগাস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গ নিয়ে লিখিত ভাষণ পাঠ করেন বদরুন্নেসা আহমদ। ১৬ সেপ্টেম্বর মেহের খন্দকার তার রচিত ‘আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মহিলা’ কথিকাটি পাঠ করেন। এতে তিনি মুক্তিসংগ্রামে নারীদের অবদান তুলে ধরেছেন। মিস ডলি নাথ তার রচিত ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ও বাংলার নারী’ শিরোনামে কথিকা পাঠ করেন ২২ সেপ্টেম্বর। ৪ নভেম্বর জেবুন্নাহার আইভি রচিত ‘মুক্তিসংগ্রামে মায়ের প্রেরণা’ কথিকা পাঠ করা হয়। এই কথিকায় আনোয়ার নামক এক যুবকের মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের গল্প এবং এতে তার মায়ের উৎসাহের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ৫ নভেম্বর নূরজাহান মাযহার তার রচিত ‘মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গ বীরাঙ্গনা’ নামে কথিকা পাঠ করেন। এই কথিকায় তিনি মায়েরা সন্তানকে, বোনেরা ভাইকে এবং স্ত্রীরা স্বামীকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য যে প্রেরণা দিয়েছেন সেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাদের রচিত এই কথিকাগুলো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাংলার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তেমনি অবরুদ্ধ দেশে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধপন্থি ও সাধারণ জনতার মনোবল বৃদ্ধিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রধানত দুই ভাগে পরিচালিত হতো। একটি তথ্য বিভাগ ও অন্যটি সংগীত বিভাগ। সংগীত শাখার প্রধান কাজ ছিল উদ্দীপনামূলক গান প্রচার করে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বদেশবাসীকে প্রেরণা জোগানো। মুক্তির জন্য গণমানুষকে জাগ্রত করার জন্য একদিকে যেমন সৃষ্টি হয়েছে নিত্য নতুন গণসংগীত, অন্যদিকে জাগরণের জন্য উদ্দীপ্ত বাংলা গান যেমন স্বদেশী গান, রবীন্দ্রসংগীত, মুকুন্দ দাসের গান, নজরুল সংগীতসহ জনপ্রিয় গানগুলো নির্বাচন করে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়েছে। সংগীত বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন নমিতা ঘোষ, বুলবুল মহলানবীশ, মালা খান খুররুম, কল্যাণী ঘোষ, রূপা খান (ফরহাদ), মঞ্জুলা দাসগুপ্তা, শাহীন সামাদ, শীলা ভদ্র, শীপ্রা ভদ্র, শুক্লা ভদ্র, ঝর্ণা ব্যানার্জী, লীনা দাস, সাকিনা বেগম, দীপা ব্যানার্জী, কণিকা রায়, মিনু রায়, মিতা চ্যাটার্জী, মলিনা দাস, সুফিয়া খাতুন, দিলশাদ বেগম, অর্চনা বসু, কণা, মিতা ঘোষ, ডালিয়া নওশীন, ফ্লোরা আহমেদ, ভক্তি রায়, মাধুরী আচার্য, মিতালী মুর্খাজী, মিলিয়া গণি, শীলা দাশ, শক্তি শিখা দাস, শেফালী ঘোষ, ছন্দা, শর্মিলা দাশ, হেনা বেগম, পূর্ণিমা দাস, সৈয়দা নাজনীন নীনা, রেহেনা বেগম, নীলা দাশ, জয়ন্তী লালা, কুইন মাহজাবীন, রানী প্রভা চৌধুরী, রানা হায়দার, দেবী চৌধুরী, আরতী ধর, সন্জীদা খাতুন, কল্যাণী ঘোষ, শেফালী ঘোষ, স্বপ্না রায়, রমা ভৌমিক, নায়লা জামান, মঞ্জুলা দাসগুপ্ত, উমা চৌধুরী, কল্যাণী মিত্র, মঞ্জুশ্রী নিয়োগী, অনিতা বসু, রেহানা বেগম, শেফালী সান্যাল, অরুণা রানী সাহা, গীতশ্রী সেন, আফরোজা মামুন প্রমুখ। এই শব্দসৈনিকগণ সমবেতভাবে যে সকল গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে’, ‘স্বাধীন কর মুক্ত কর জয় বাংলা’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘সোনা সোনা সোনা’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি’, ‘স্বাধীন দিকে দিকে’, ‘ও চাঁদ তুমি ফিরে যাও’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’, ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, ‘রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নেব’, ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন মোরা সইবো না’, ‘আমরা সবাই মুক্তি সেনা’, ‘এদেশ বিপন্ন আজ’, ‘শৃঙ্খল ভাঙা সুর বাজে পায়’, ‘চল বাঙালি চল’, ‘নাই ঈদ আজ নাই ঈদ এই বাংলাদেশে’, ‘আমরা যখন মুক্ত হব তখন করব ঈদ’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘সংগ্রাম আজ সংগ্রাম’, ‘আমার নেতা তোমার নেতা’, ‘আমি এক বাংলার মুক্তিসেনা’, ‘এবার উঠেছে মহাঝড়’, ‘এ ঘর দূর্গ’, ‘হুশিয়ার বাংলার মাটি’, ‘রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নেব’, ‘সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ’ ইত্যাদি। নারী শব্দ সৈনিকদের মধ্যে কাজী রোজী, বেগম মুশতারী শফী, লায়লা হাসান আবৃত্তির সাথে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠ, কথিকা রচনা ও পাঠ, নাটক, সংগীত, আবৃত্তি ও সাহিত্য আসর সকল ক্ষেত্রেই নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তারা তাদের কণ্ঠ দিয়ে এদেশের আপামর জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উজ্জীবিত করে রেখেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠ, প্রেরণার উৎস, বিক্ষুব্ধ চেতনার প্রতিচ্ছবি, যেখানে নারী শব্দ সৈনিকদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে সনজীদা খাতুনের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা। এই শিল্পী সংস্থার সদস্যরা শুধু কলকাতায় নয়, বিভিন্ন সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে গান শোনাতেন। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তির উদ্যোগে বাংলাদেশের মানুষ এবং বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে সভাপতি করে গঠিত বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতিই পরবর্তী সময়ে গঠিত মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার জননবীজ। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সাথে নারীদের মধ্যে যুক্ত ছিলেন সনজীদা খাতুন, বুলবুল মহলানবীশ, শুক্তি মহলানবীশ, ফ্লোরা আহমদ, শারমিন সোনিয়া মুর্শীদ, ডালিয়া নওশিন, দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জুশ্রী নিয়োগী, মঞ্জুলা দাস গুপ্তা, ঝর্ণা ব্যানার্জি, অর্চণা বসু, শাহীন সামাদ, অরুণা রাণী সাহা, শান্তি মুখার্জি, কল্যাণী ঘোষ, মিঠু চক্রবর্তী, উমা চৌধুরী, শীলা দাশ, শর্মিলা দাশ, নীলা দাশ, রাখী চক্রবর্তী, সুমিতা নাহা, তাজিন মুরশিদ, লায়লা জামান, লতা চৌধুরী, লুবনা জাহান, মিলিয়া গণি প্রমুখ। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা গঠিত হবার পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সংস্থাটি কমলা গার্লস স্কুলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, স্কুলের অধ্যক্ষ কবি বিষ্ণু দের স্ত্রী প্রণতি দে এ অনুষ্ঠান সফল করতে সহযোগিতা করেন। এই শিল্পী সংস্থার সদস্যরা শুধু কলকাতায় নয়, বিভিন্ন সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে গান শোনাতেন। কখনও তারা পায়ে হেঁটে, কখনও নৌকায় চড়ে, আবার কখনও ট্রাকে করে এক সীমান্ত থেকে অন্য সীমান্তে যেতেন। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার ট্রাকই হয়ে উঠেছিল শিল্পীদের বাসস্থান। এভাবে তারা দেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত ২৫০টির বেশি অনুষ্ঠান করেছিলেন। দিল্লির একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও এই সংস্থা ‘রূপান্তরের গান’ পরিবেশন করেছিল। গানের পূর্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। তাই এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম বিশ্ববাসীর চেতনায় আঘাত হানতে সক্ষম হয়। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার ব্যানারে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলোতে ‘জনতার সংগ্রাম চলবে’, ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’, ‘বিপ্লবের রক্ত রাঙা ঝান্ডা উড়ে আকাশে’, ‘ব্যারিকেড বেয়োনেট বেড়াজাল’, ‘মানুষ হ মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ’, ‘ওরে বিষম দৈরার ঢেউ উথাল পাথাল করে’, ‘মোদের গরব মোদের আশা’, ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখগান গাহি’, ‘ঢাকো রে মুখ, চন্দ্রমা, জলদি’, ‘চল যাই চল যাই চল যাই’, ‘শিকল পরা ছল মোদের এই’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘পাক পশুদের মারতে হবে চলো রে নাও বাইয়া’ প্রভৃতি গান পরিবেশন করা হয়। এই সকল গানের মধ্য দিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের উজ্জীবিত করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার অন্যতম শিল্পী কল্যাণী ঘোষের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের প্রায় ৩৫জন কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, আবৃত্তিকারদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী’ গঠিত হয়। এই শিল্পী গোষ্ঠীর নারী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মিতালী মুখার্জী, পূর্ণিমা দাশ চৌধুরী, উমা চৌধুরী, জয়ন্তী লালা, দেবী চৌধুরী প্রমুখ। এই শিল্পী গোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনে প্রতিনিয়ত সংগীত পরিবেশন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। এই সংগঠন যে সকল অঞ্চলে জাগরণী গান পরিবেশন করে তার মধ্যে দুর্গাপুর, বর্ধমান, বহরমপুর, আসানসোল, জামশেদপুর, কলালীম, বারাসাত, কৃষ্ণনগর, বসিরহাট, সল্টলেক, মেদিনীপুর, রবীন্দ্রসদন, মহাজাতিসদন, কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালে আগরতলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত সংস্কৃতি কর্মীরা ভ্রাম্যমাণ শিল্পী সংস্থা সংগঠন গড়ে তোলেন। এ দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে উদ্দীপনামূলক গান পরিবেশন করতেন। এই সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন ছবি পাল, রুবি পাল, শঙ্করী রায়, সুমিত্রা ভট্টাচার্য, দিলারা হারুন প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবিরে স্বাধীনতা সংগীত দল গঠিত হয়। এই সংগঠনটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন কণিকা দাস, বেবী দাস, কৃষ্ণ দাস, লিপিকা দাস, হেনা, দীপালি রায়, উমা, শান্তি, মুরারী সাহা, মিসেস মুরারী সাহা, শেফালি রায় প্রমুখ। এই সংগীত দলের শিল্পীরা পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির, গোমতী যুব শিবির, দুর্গা চৌধুরী পাড়া যুব শিবির, ইছামতি যুবশিবিরসহ অন্যান্য যুবশিবিরে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কর্মকাণ্ড পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কুমিল্লার স্থানীয় বিক্ষুব্ধ শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীরা গণসংগীত শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ’ গড়ে তোলেন। এই সাংস্কৃতিক সংঘে সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন জোৎস্না রাণী ভৌমিক, মায়া সাহা, শাকিলা চৌধুরী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, নীলিমা সাহা, রত্না বিশ্বাস প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস শরণার্থী শিবির, যুব শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অবিরাম জাগরণী গান গেয়েছে এ সাংস্কৃতিক সংঘের সদস্যরা। ক্যাম্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পালাটানা, কোনাবন, ধ্বজনগর, খিলপাড়া, রাজারবাগ, মাতারবাড়ি প্রভৃতি। এছাড়া এই সংঘ বিভিন্ন স্কুলের মাঠেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের সমাজসেবা ও সংস্কৃতি সম্পাদক জনাব কে এম ওবায়দুর রহমানকে উপদেষ্টা এবং খোন্দকার আব্দুল হান্নানকে কার্যকরী পরিষদের সভাপতি করে গঠিত হয় শরণার্থী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। এই সংগঠনের প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম দিনাজপুরের বালুর ঘাটের নারায়ণপুরে এবং কলকাতায় যোগাযোগের দপ্তর ছিল নারকেলডাঙ্গা মেইন রোডে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে শরণার্থী শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে কলকাতায় ‘এক পথিকের গল্প’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় এবং বহুল প্রশংসিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা, জনমত তৈরি করা এবং তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করা হয়। নৃত্যনাট্য মঞ্চায়ন উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনার জনাব এম হোসেন আলী, কে এম ওবায়দুর রহমান এবং অনিল চট্টোপাধ্যায়। শরণার্থী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তৃপ্তি রায় চৌধুরী। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন বেগম এ এ জলিল। এই গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অনামিকা চাকলাদার, শিখা দাশ, রেখা দাশ, দিপা দাশ, শুক্লা সরকার, সুনন্দা চাকলাদার এবং সংগীতশিল্পী হিসেবে ছিলেন মমতাজ বেগম, আফরোজা মামুন, মিতালী মুখার্জী প্রমুখ। এই সংগঠনের সাথে আরও সম্পৃক্ত ছিলেন জিনাত চৌধুরী, জ্যোতি দাশ এবং মীরা রায়।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ পর্বে গঠিত বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী, কলম-তুলি-কণ্ঠ সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা, বাংলাদেশ গণমুক্তি শিল্পী সংস্থা, শরণার্থী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি, বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ এবং মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী গোষ্ঠী এই সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেই নারীরা যুক্ত ছিলেন। তরুণ শিল্পী গোষ্ঠীর নারী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মিতালী মুখার্জী, পূর্ণিমা দাশ চৌধুরী, উমা চৌধুরী, জয়ন্তী লালা, দেবী চৌধুরী প্রমুখ এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহের জন্য ব্যারিস্টার বাদল রশিদের নেতৃত্বে দীলিপ সোমের গীতি আলেখ্য পরিবেশনের জন্য ১৪ জন সদস্যের একটি দল দিল্লি, বোম্বে, গোয়া, পুনা, কানপুর প্রভৃতি জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। এই দলের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন নারীরা। তারা মুক্তিযুদ্ধকালে স্থানীয় জনগণ, মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শরণার্থী শিবির, যুব শিবির, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করা ও তহবিল সংগ্রহের জন্য গণসংগীত, জাগরণী গান, দেশের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, কবিতা, নাটক, নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তাঞ্চলে ও প্রবাসে বিশেষ করে কলকাতা কেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে যেমন নারীরা যুক্ত ছিলেন তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন।