কাজী ইনামুলক হক দানু, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন অকুতোভয় বীর। ছাত্রজীবন থেকে সকল লড়াই সংগ্রামে ছিলেন সামনের কাতারে। অসীম সাহসে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। জাতির জনকের হত্যার পর আবার ঝাপিয়ে পড়েন লড়াইয়ে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার নির্যাতন অথবা এদেশীয় স্বৈরশাসকের গ্রেপ্তার-জুলুম-অত্যাচার কিছুই দমাতে পারেনি এই আজীবন যোদ্ধাকে। দলের দু:সময়ের এই কান্ডারীর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিবেদিত ছিলেন দেশ ও দলের প্রতি। প্রয়াণ দিবসে এই মহান মুক্তিযোদ্ধার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
তাঁর পিতার নাম কাজী আবদুল গফুর। গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লার দেবীদ্বারে। ১৯৪৭ সালের ১৪ মে কোলকাতায় জন্ম কাজী ইনামুল হক দানুর। প্রবর্তক বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র জীবনেই শুরু রাজনীতির পথচলা। প্রবর্তক স্কুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন সিটি কলেজে।
১৯৬২ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকার সময় বরেণ্য রাজনীতিবিদ এম এ মান্নান, আবু ছালেহ, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রউফ এবং শায়েস্তা খানের সান্নিধ্যে আসেন। যুক্ত হন ছাত্রলীগে। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
মরহুম নেতা সিরাজ মিয়ার বাড়িতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে ছয় দফা নিয়ে রাজনৈতিক ক্লাসে অংশ নেন দানু। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র জনতা। ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন দানু। পরবর্তীতে সিটি কলেজ ছা্ত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন।
১৯৬৮ সালের নভেম্বরে চকবাজার অলি বেগ খাঁ মসজিদের মোড়ে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মোনায়েম খাঁর গাড়ির গতিরোধ করে জুতা নিক্ষেপ করেন কাজী ইনামুল হক দানু। এসময় তিনি ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন। সাথে সাথে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেয়া হয়। কারাগারে করা হয় অকথ্য নির্যাতন। তাঁর সেই অসীম সাহসী প্রতিবাদ কিংবদন্তী হয়ে সারাদেশের তরুণ যুবক ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার হলে দানু কারাগার থেকে মুক্তি পান। ৭০’র নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু মোনায়েম খানকে জুতা মারার কারণে সেখানে পড়ালেখা আর চালিয়ে যেতে পারেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দানু ঝাপিয়ে পড়েন অসহযোগ আন্দোলনে। মৌলভি সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হলো জয় বাংলা বাহিনী। স্থানীয় ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থায় লেগে গেলেন।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে সোয়াত জাহাজ আসার খবর পেয়ে শহরের সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করেন। যাতে গোলাবারুদ খালাস করে তা নিয়ে আসা সম্ভব না হয়।
এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে চৌদ্দগ্রাম দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় যান। দেরাদুনে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ নিতে। বিএলএফ এর একটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছাগলনাইয়া সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। অবস্থান নেন চকবাজার জয়নগর এলাকার নিজ বাসায়। সেখানে থেকেই তিনি অপারেশনে অংশ নিতেন।
মনসুরাবাদ রাজাকার মোহাম্মদ আলীর (ফজলুল কাদের চৌধুরীর সহযোগী) মালিকানাধীন পেট্রোল পাম্পে অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলো এই মোহাম্মদ আলী। অপারেশনের পর মোহাম্মদ আলী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সিজিও বিল্ডিং এ ফজলুল কাদের চৌধুরী আছে জানতে পেরে সেখানেও অভিযান চালান। কিন্তু অভিযানের আগেই সেখান থেকে সরে যায় ফজলুল কাদের চৌধুরী। এ অভিযানের পর পাঠানটুলির খানবাড়ির শেল্টার থেকে সহযোদ্ধা ডা. জাফরসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন।
পাঁচলাইশ থানার দক্ষিণে একটি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফর, হারুন খানসহ অন্যদের আটকে রাখা হয়। তাদের উদ্ধারে গেলে দুই রাজাকারের রাইফেলের মুখে পড়েন। রাজাকারদের আটকের পর পড়েন পাঞ্জাবি সেনাদের মুখে। দুজন পাঞ্জাবি সেনা দানুর দিকে বন্দুক তাক করলে দুই সহযোদ্ধা শান্তনু ও কামরুল গুলি চালান। সেদিন মুত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন কাজী ইনামুল হক দানু।
চট্টগ্রাম শহরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ছিল ‘অপারেশন চট্টগ্রাম কাস্টম পেট্রোল পাম্প’। চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন পেট্রোল পাম্পটি থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাদের গাড়ির জন্য জ্বালানি নিত। পাশাপাশি অবাঙালি ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে পণ্য খালাসের জন্য ব্যবহূত গাড়িতে ওই পেট্রোল পাম্প থেকে জ্বালানি নিত। তাই গেরিলারা সিদ্ধান্ত নেন পেট্রোল পাম্পটি উড়িয়ে দেবেন। কাজী ইনামুল হক দানুর নেতৃত্বে ওই অপারেশনটি সফলভাবে পরিচালিত হয়।
আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে মৌলভী সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে গোপন বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের জন্য যানবাহন সংকট ও খরচ নির্বাহের জন্য আমেরিকান প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী এনামুল হক দানু, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন, ডা. জাফর উল্লাহ, অমল মিত্র, শফিউল বশর, ফজলুল হক ভূইয়া, ফখরুল আহসান মনি, আব্দুল আজিজ এই অপারেশন দলে ছিলেন। পরবর্তীতে অপারেশনটির নামকরণ হয় ‘অপারেশন আমেরিকান এক্সপ্রেস’।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর রনাঙ্গনে আর একটি বড় সফল গেরিলা অপারেশন ‘অপারেশন ফায়ার ব্রিগেড’ চট্টগ্রাম শহরের গেরিলা বাহিনী প্রধান মৌলভী সৈয়দের সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানরত প্রায় সকল গেরিলা গ্রুপ গুলোর যৌথ বা সম্মিলিত গেরিলা অপারেশন ছিলো এটি। শেখ মুজিব রোড এ কর্ণফুলী বাজারের বিপরিতে ‘ফায়ার বিগ্রেড’ ভবনের অভ্যান্তরে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে হামলাই ছিল মূল লক্ষ্য। মৌলভী সৈয়দ, সিনিয়র কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার আবছার উদ্দীন এর যৌথ নেতৃত্বে গভীর রাতে বিপুল সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা চারিদিকে ঘিরে এই অপারেশনটি করেছিলেন। এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন মৌলভী সৈয়দ, ইঞ্জিনিয়ার আবছার উদ্দীন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন, আবু সাইদ সরদার, ডা. মাহফুজুর রহমান, কাজী ইনামুল হক দানু, ডা. মাহাবুবুল আলম, ডা. জাফর উল্লাহ, মো. হারেস, জালাল উদ্দিন আহম্মদ, ফজলুল হক ভুইয়া, অমল মিত্র, বোরহান উদ্দিন, জাহিদ হোসেন, লোকমান গনিসহ বিপুল সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা।
১৯৭১ সনের রণাঙ্গনের এই বীরযোদ্ধা দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব ও নেতা ছিলেন। কোনো অশুভ চক্রের রক্তচক্ষু, ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি, জেল-জুলুম, নির্যাতন, প্রলোভন কোনো কিছুই দেশপ্রেমের প্রশ্নে তাঁকে দমাতে পারেনি। কখনো মাথা নত করেননি পরাক্রমশালী কোনো শক্তির কাছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার পর প্রতিশোধ নিতে আবারো অস্ত্র হাতে তুলে নেন কাজী ইনামুল হক দানু। নগরীর কিছু গুরুত্বপূর্ণূ স্থাপনায় চোরাগোপ্তা হামলা চালান। সামরিক জান্তার সাঁড়াশি অভিযানের মুখে এক পর্যায়ে মৌলভি সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, কাজী ইনামুল হক দানুসহ দলের সদস্যরা ভারত পাড়ি জমান। ফিরে এসে আবারো মৃত্যুর সাথে লুকোচুরি খেলা শুরু করেন। চোরাগোপ্তা হামলায় অতিষ্ট সামরিক জান্তার হাতে এক পর্যায়ে ধরা পড়েন। ক্যান্টনমেন্টে আটক অবস্থায় অমানুষিক টানা নির্যাতনে তিনি প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েন। অবিশ্বাস্য নৃশংসতা চালানো হয় তাঁর উপর। কিন্তু দমানো যায়নি এই সংশপ্তক অভিযাত্রীকে। চট্টগ্রামে জান্তা, জামাত-শিবির প্রতিরোধ আন্দোলনে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছিলেন প্রতিবাদী কাজী ইনামুল হক দানু।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি হন। বাংলাদেশ যুবলীগ নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। তারপর যুক্ত হন আওয়ামী লীগে। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পান। এরপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সর্বশেষ ২০০৬ সনের ২৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কাজী ইনামুল হক দানু।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ এর ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ সালের মহাসচিব। পালন করেন কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইনামুল হক দানু মৃত্যুবরণ করেন। জীবনে কোনো পরাভব তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। চির প্রতিবাদী বীর কাজী ইনামুল হক দানু অমর হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসে।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট- চট্টগ্রাম
সাম্প্রতিক খবর