পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন

573

৯ মাস নির্জন কারাবাসের যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, যে কোনো সময়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলার পরিস্থিতি অতিক্রম করে বিশ্ব জনমতের চাপে ৮ জানুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে নিজের পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছে না গিয়ে সরাসরি জনগণের কাছে ফিরে এসেছিলেন। লাখো মানুষের সামনে তিনি সেদিন বলেছিলেন, “… আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।…”

আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, পাকিস্তানের নতুন সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো কারাগারে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথাও জানানো হয়। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা রেডিওর সংবাদে শোনার পর বাংলাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে সারারাত মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল-স্টেনগানের ফাঁকা আওয়াজ করে আনন্দ-উল্লাস করেছিল। রাস্তায় নেমে এসেছিল লাখ লাখ মানুষ।ঢাকা বা দিল্লি না গিয়ে লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু ঢাকা না গিয়ে লন্ডনে গেলেন কেন? এ সম্পর্কে লন্ডনে সাংবাদিক সুন্দর কাবাদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারটির সার-সংক্ষেপ আজকের মানুষের সামনে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না। লন্ডনে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “… বন্দি হিসেবে তাঁর ঢাকায় যাওয়ার বদলে লন্ডনে না এসে উপায় ছিল না। তিনি ঢাকাতেই যেতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ভুট্টো তাতে রাজি হননি। তাঁকে ভারতে যেতে দিতেও ভুট্টো নারাজ। ভুট্টো শেখ মুজিবকে তেহরান অথবা ইস্তাম্বুলে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব ওই দুই জায়গার কোনো জায়গায়ই যেতে রাজি হননি।” ভুট্টোকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তেহরান বা ইস্তাম্বুল যাওয়ার বদলে তিনি পাকিস্তানের কারাগারেই থাকবেন এবং এই সিদ্ধান্ত থেকে এতটুকু নড়বেন না।
এরপরই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠাতে রাজি হলেন। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আসা। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনোরকম একটা সম্পর্ক রাখা যায় কি না? বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, দেশে ফিরে সবার সঙ্গে আলোচনা না করে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য আমরা একটু দেখে নিতে পারি। “… আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছি।… পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হওয়ার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করে।
আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ‘বিশ্বাসঘাতক’র কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনও প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন।
কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকার করেন। জনাব ভুট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্য নিষ্প্রদীপ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল যেখানে আমাকে তারা কোনো রেডিও, কোনো চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা জানতে দেয়া হয় নাই।”
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সময় দুপুর ৩টায় “রেডিও পাকিস্তান ঘোষণা করে যে, শেখ মুজিবের ইচ্ছানুসারে একটি বিশেষ পাকবিমানে তাঁকে লন্ডনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিনি লন্ডনের ক্লারিজস হোটেলে অবস্থান করছেন।” ওই সময় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে যথাসম্ভব শিগগিরই লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার আয়োজন করা হচ্ছে।
আগামীকালের মধ্যে শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতেই হবে বলে জনাব চৌধুরী উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা বিমানক্ষেত্রটি এখনও আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণের উপযোগী হয়নি। তাই লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে হয়তো মাঝে কোথাও তার বিমান বদল করার প্রয়োজন হবে। আমরা জেনে থাকব বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনের তুলনায় এক মিনিটও বেশি লন্ডনে থাকেননি। ব্রিটিশ সরকার তাকে আরামে রাখার জন্য যথাসম্ভব করেছেন।
৪০ বছর আগে গান্ধীজিকে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন, এবার শেখ মুজিবকেও তারা সেভাবে গ্রহণ করেছেন। যদিও ব্রিটিশ সরকারের একজন মুখপাত্র একদিন পূর্বে বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব ব্রিটিশ সরকারের অতিথি নন; কিন্তু তবুও ব্রিটিশ সরকার তার প্রতি আতিথেয়তা দেখিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিথ তার ব্যবহারের জন্য রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইয়াহিয়া খানের কাছে তিনি ধরা দিলেন কেন? অনেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন… অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি তাও অস্বীকার করেছি।”
তিনি বলেছিলেন, “যখন তাঁর দেশবাসী বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিচ্ছে তখন ভারতে পালিয়ে যাওয়াও তাঁর পক্ষে কাপুরুষতা বলে মনে হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই পরিসরে উপস্থাপন করা যায়, প্রখ্যাত লোক গবেষক বাংলা একাডেমির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের বই ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ এবং প্রাসঙ্গিক কথকতা’ থেকে জানতে পারি। ১৯৭৪ সালের দিকে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম, লেখক সাংবাদিক রাহাত খান, শামসুজ্জামান খান এবং বাংলা একাডেমির তৎকালীন সংস্কৃতি বিভাগের ম. জিল্লুর রহমান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
সেখানে কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। ‘২৫ শে মার্চ (১৯৭১) রাতে আমি গ্রেফতার হবার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেই। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে ওয়্যারলেসে সে ঘোষণা সব জেলা সদরে পাঠানো হয়। আমি বিভিন্ন চ্যানেলে ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ করে যাই। তা না হলে তোমরা অত সহজে অস্ত্র ও সাহায্য সহযোগিতা পেতে না।’ আমরা প্রশ্ন করলাম কিন্তু আপনি কেন ওদের হাতে ধরা দিলেন। তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার বেশ ক’টি চিন্তা কাজ করেছে।
এক. আমাকে ধরতে না পারলে ওরা আরও বেশি লোককে খুন করত; দুই. আন্তর্জাতিকভাবে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়ানক বলে প্রমাণিত হতাম এবং এতে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা কমতো এবং আরও বেশি দেশ আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতো। আর একটা কথা বলি, তোমরা কীভাবে নেবে জানি না, প্রফেসর সাহেব আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না তাও বলতে পারি না- তবে আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস আমি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় আমার দুঃখী বাঙালিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ যেমন বেড়েছে তেমনি মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে আমার একটা বিশাল প্রতীক মনে মনে তৈরি করে নিয়েছে।
এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের খুব বড় একটা শক্তি। আমি প্রবাসী সরকারে থাকলে শুধু প্রমাণ সাইজের মুজিবই থাকতাম। ওদের হাতে বন্দি থাকায় আমি এক মহাশক্তিধর ও বাংলাদেশের সব মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার ভূমিকায় স্থান পাই। মানুষ আমার নাম নিয়ে হেলায় হেসে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কি অমোঘ অস্ত্র ছিল, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলত, তাহলে আমি আরও বড় প্রতীকে পরিণত হতাম। বাংলার মানুষ আরও লড়াকু হয়ে যুদ্ধ করত।’
বঙ্গবন্ধু আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কখনই আপস করেননি। শেখ মুজিব স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাক বা না থাক, সেটা কারও দেখার দরকার নেই। সেটা শুধু তার দেশ আর ভারতের মধ্যকার ব্যাপার। কেউ যেন তাকে এ বলে হুমকি দেওয়ার সাহস না করে যে, তার দেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে না নিলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। ব্ল্যাকমেলের কাছে নতিস্বীকার করার বদলে তিনি এইরকম স্বীকৃতি ছাড়াই থাকবেন। চীন বহু বছর স্বীকৃতি পায়নি। তাতে সে দেশের অবলুপ্তি ঘটেনি। বাংলাদেশ এখন একটা জীবন্ত শক্তি। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লন্ডনে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ছিলেন। এর মধ্যে তিনি এতটুকু ঘুমোতে পারেননি, বিশ্রাম নিতে পারেননি। দেশের পরিস্থিতি নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে শোনার জন্য তিনি লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার সংবাদ বলছে- বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি সুস্থ আছি, বেঁচে আছি। এ মুহূর্তে আপনারা শুধু আমাকে দেখুন, কিছু শোনার আশা করবেন না। আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। সম্ভবত আজকের পরে একটা বিবৃতি দিতে পারি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্তান সরকারের চার্টার করা পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগের ১০ ঘণ্টা পর ৮ জানুয়ারি গ্রিনিজ সময় ৬টা ৩৬ মিনিট (বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৬ মিনিট) হিথ্রু বিমানবন্দরে পৌঁছে যান। লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সাত ঘণ্টা পর বিষয়টি জানাজানি হয় বলে সেই সময়ের পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছে তিন ঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থান করেন। তিন ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে ওয়েস্ট অ্যান্ড এর ক্লারিজস হোটেলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি সামনে বসতে পারেন কি না জিজ্ঞেস করলে কর্মকর্তারা বলেন,“অবশ্যই।” এ সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
পরবর্তীতে হোটেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, “আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই, আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।”
বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি আগামীকাল বা পরের দিন ঢাকা ফিরবেন আশা করছেন। বাংলাদেশ শিগগির জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য অনুরোধ করবেন। বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থনের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্সকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ এখন অবিসংবাদিত সত্য এবং এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে।” বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, “যখন তার জনগণ তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনো রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। মরার জন্য মনের দিক থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম।
যেদিন জেলে নেওয়া হলো তখন আমি বাঁচবো কি না ধারণা ছিল না। তবে এটা জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই। আমার দেশের লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছে। বেঁচে থাকলে হিটলারও লজ্জা পেতো।”
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন থেকে টেলিফোনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম প্রশ্ন ছিল- ‘বেঁচে আছ তো?” ২৫ মার্চের দুর্বিষহ কালরাতের পর ৮ তারিখ (১৯৭২) প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কথা শুরু করেন এভাবে, “তোমরা সবাই বেঁচে আছ তো?” সেই শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে হোটেল থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আধাঘণ্টা কথা বলেন। প্রথমে বড় ছেলে শেখ কামাল, পরে ক্রমান্বয়ে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাবহুল ও দুর্বিষহ ৯ মাস পর পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলেন। বেগম মুজিব আবেগঘন কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
এনা পরিবেশিত খবর থেকে জানতে পারা যায়- বেগম মুজিব সাংবাদিকদের জানান তিনি আবেগে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রথমবার কথা বলতে পারেননি। দ্বিতীয়বার কল আসলে বঙ্গবন্ধু জানতে চান- “আমি কেমন আছি।” আমি বললাম, “আমরা ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?” লন্ডনে থাকাকালেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানান।
ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের কুশল জানতে চেয়ে বলেন, ‘আমরা খুবই খুশি আপনি মুক্তি পেয়েছেন।’ শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের জনগণকে অভিনন্দন জানান। এরপর ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান, ‘কেমন আছেন?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ভালো আছি। আমি আপনাদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।’ ৮ তারিখে তার কথা হয়েছিল সহযোদ্ধা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘হ্যালো তাজউদ্দীন, আমি সাংবাদিক পরিবৃত আছি, তাদের কী বলবো? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন, এই মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’
একজন কারারুদ্ধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ভুট্টোর কবল থেকে বিনা শর্তে মুক্তিলাভ। ১৯৭১ সালে ৯ মাস কারাবাসকালে বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তাঁর বিচারের প্রহসন-মৃত্যুদণ্ড।
পাকিস্তানের মিয়াওয়ালি জেলে অবস্থানকালে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেখানে তাঁর কবর খোঁড়ার আয়োজন। বহু বছর কারাবাসের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেখ মুজিব জেলে বসেই স্থাপন করেছিলেন জেলের ডিআইজি শেখ আবদুর রশিদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। এল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।আমাদের বিজয় দিবস। বাংলাদেশে পরাজিত জেনারেল নিয়াজির বাড়িও মিয়াওয়ালিতে। সেখানেই কারাগারে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তানের পরাজয়ের কোনো হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া যদি মিয়াওয়ালি জেলে ঘটে, সেই ভয়েই শেখ রশিদ বঙ্গবন্ধুকে স্থানান্তরিত করলেন তাঁর বাসস্থানে। অন্তরীণ অবস্থায়ই। তার কিছুদিন পরই পাকিস্তানে তখ্ত পাল্টাল, ইয়াহিয়াকে সরিয়ে ক্ষমতার আসনে বসলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাঁরই আদেশে বঙ্গবন্ধু অন্তরীণ অবস্থায়ই স্থানান্তরিত হলেন রাওয়ালপিন্ডির অদূরে সিহালা অতিথি ভবনে। সেখানেই ২৭ ডিসেম্বর হলো মুজিব-ভুট্টোর সাক্ষাৎকার। দুজন তখন দুটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু একজন অন্তরীণ অন্যজনের হাতে।
সিহালা অতিথি ভবনে ছিল বেতারযন্ত্র। রেডিওতে বঙ্গবন্ধু শুনতে পেয়েছেন ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির কথা। বুঝতে পেরেছেন ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় তাঁর অবস্থান দুর্বল নয় মোটেও। কারণ, বন্দি হলেও তিনি আসলে বিজয়ী। বঙ্গবন্ধু তাই ভুট্টোর কাছে করলেন তাঁর মুক্তির দাবি। ভুট্টোর উত্তর, আর কিছুদিন আমাকে সময় দিন।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা, পাকিস্তানের সেই সময়কার অনিশ্চিত পঙ্কিল রাজনীতিতে যেকোনো মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে দেশে আবার যদি হয় সামরিক অভ্যুত্থান? যদি গণেশ যায় উল্টে! তাই শুভস্য শীঘ্রম্। বঙ্গবন্ধু তখন বুঝতে পেরেছেন যে ভুট্টো তাঁকে মুক্তিদানে বাধ্য। কারণ, পরাজিত ভুট্টোর অনেক কিছুই চাওয়ার রয়েছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। কিন্তু তাঁকে মুক্তি লাভ করতে হবে বিনা শর্তে মুক্তি।
৭ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে জানালেন নিকটবর্তী রাষ্ট্রপতির অতিথিশালায় নৈশভোজের আমন্ত্রণ। সেখানেই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে তিনি তাঁকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তার পরদিনই পাকিস্তান সফরে আসছেন ইরানের শাহ। তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুর দর্শনগ্রহী।
বঙ্গবন্ধু তাই আরও দু-একটি দিন কেন থেকে যান না। বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা, ভুট্টো আর ইরানের শাহ এই দুই বন্ধু মিলে হয়তো বা করবেন তাঁর ওপর নানা রকম মুক্তিশর্ত আরোপের প্রচেষ্টা। এ সুযোগ তাই ভুট্টোকে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ‘না ভুট্টো, আমাকে যেতেই হবে। আমার জনগণ আমার অপেক্ষায় রয়েছে। আমার আর থাকার উপায় নেই।’ নিরূপায় ভুট্টো তাই একাই পড়লেন কনফেডারেশনের কথা। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ মিলে কেন একটি কনফেডারেশন করা সম্ভব নয়। যার রাষ্ট্রপতি হবেন বঙ্গবন্ধু, ভুট্টোর জিজ্ঞাসা। ভুট্টোর অভিপ্রায় কনফেডারেশনের প্রতিশ্রুতি আদায়।
মুজিবের ইচ্ছে, কথা বলে ভুট্টোর খপ্পর থেকে যথাসম্ভব শিগগির কেটে পড়া। কারণ, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে পারদর্শী ভুট্টো। রাজনীতিতে কাউকে এবং কিছুতেই বিশ্বাস নেই। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমাকে প্রথম দেখা করতে হবে আমার জনগণের সঙ্গে… আমার প্রয়োজন সময়ের…আমি আপনাকে দেশে ফিরেই জানাব।’
কোনো নিশ্চিত উত্তর প্রদানের আগে তাঁর জনগণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথা বলার প্রয়োজনীয়তার যুক্তি খন্ডানো সম্ভব হলো না ভুট্টোর। অকাট্য যুক্তির ওপর খাটে না কোনো জবরদস্তি। তাই তাঁকে কালবিলম্ব না করেই যেতে দিতে হবে। আরও একটি শেষ অপচেষ্টা ভুট্টোর। হাত খরচ হিসাবে পঞ্চাশ হাজার ডলার তিনি দিতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুকে। কপর্দকহীন শেখ মুজিব সেই ফাঁদে পা দেওয়ার পাত্র নন। সবিনয়ে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, ‘ধন্যবাদ, এই অর্থ আপনি আমার যাত্রা খরচ হিসেবেই রেখে দিন।’
পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের মুহূর্ত থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গৌরবজনক আসন প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন সচেষ্ট। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনে পদার্পণের পর থেকে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় তাঁর জনসভায় ভাষণদান পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র পঞ্চাশ ঘণ্টার কিছু বেশি।
কিন্তু সেই সময়টুকুর মধ্যে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির আস্বাদ লাভের সেই প্রথম প্রহরগুলোতেই আন্তর্জাতিক সমাজে বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের বিবরণ আগ্রহ-উদ্দীপক। কারণ, সেই আবেগপূর্ণ সময়টির মধ্যেও এক আশ্চর্য সাবলীলতায় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন।
যুদ্ধে পাকিস্তান ছিল আমাদের শত্রু। কিন্তু তিনি যথার্থভাবেই অনুধাবন করেছিলেন যে, বাংলাদেশের সদ্য কারামুক্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর কর্তব্য পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ কী ধরনের সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক তা স্পষ্ট ভাষায়, কালক্ষয় না করেই, প্রকাশ করা। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে লন্ডন পৌঁছার অব্যবহিত পরই সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি মি. ভুট্টোর সঙ্গে আমার আলোচনায় মি. ভুট্টো আমার কাছে আর বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে এই আবেদন করেছেন যে, আমরা যেন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো প্রকার সম্পর্ক বজায় রাখার সম্ভাবনা বিবেচনা করি। আমি মি. ভুট্টোকে বলেছি যে আমার দেশবাসীর কাছে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় পাকিস্তান অনেক ষড়যন্ত্র করেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সৃজনশীল কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। তাই ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনের একটা। আমরা কখনই ভাবতে পারবো না বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেতে পারতো।
কেননা বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকা অবস্থায় ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল। বলতে গেলে চীন, সৌদি আরব ছাড়া প্রায় সব দেশের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধু আদায় করে এনেছিলেন। সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক ধীরে ধীরে অগ্রগতির দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশের অগ্রগতি সমৃদ্ধি সবই বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা কাঠামোর মধ্য দিয়ে।
তার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দুর্গমগিরি কান্তার মরু পথ। যুক্তরাজ্যে অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশ। সবই সম্ভব হয়েছে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।