ঐতিহাসিক ৮ জানুয়ারি । দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের বন্দি শিবিরে কারাযন্ত্রণা ভোগের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন।
১৯৭১–এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নৃশংস গণহত্যা ‘অপারেশনসার্চ লাইট’ শুরু করার মূহূর্তে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেনিয়ে যায়। গ্রেফতারের কিছু আগেই ’৭১–এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতাআনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের ২ দিন পরে তাকে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী বন্দি অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরের মিলানওয়ালী কারাগারের একটি নির্জন কক্ষে আবদ্ধ করে রাখে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার আলোকে দেশে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মিলানওয়ারীকারাগারের নির্জন কক্ষেই বন্দি অবস্থায় রাখা হয় এবং তাকে কোনো পত্রপত্রিকা পড়াসহ বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নকরে রাখে ইয়াহিয়া–টিক্কা খানের সামরিক জান্তা।
১৯৭১–এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানতখনো পাক বাহিনীর কারাগারে বন্দি থাকায় স্বাধীনতার পূর্ণ আস্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল বাঙালি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকপর্যায়ের ব্যাপক কূটনৈতিক চাপে এবং বিশ্ব শীর্ষ নেতাদের তীব্র সমালোচনার মুখে অবশেষে ১৯৭২ সালের ৭/ ৮ জানুয়ারিরমধ্যরাতে পাকিস্তানের সরকার বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা ও সে সময়ে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম প্রবাদ পুরুষবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের জল্লাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিহিত ইয়াহিয়া খানের পতনঘটে এবং এ সময় তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যান। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি খুব ভোর বেলা লাহোর বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনালএয়ার লাইন্সের একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির খবর প্রথম প্রচার করে রেডিও পাকিস্তানের খবরে–এতে বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকেমুক্তি দিয়ে লাহোর বিমানবন্দর থেকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে–তবে তার গন্তব্য স্থল সম্পর্কে রেডিও পাকিস্তান কোনো খবর না দিয়েঅজ্ঞাত রাখে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানি বন্দি শিবির থেকে বহুল প্রত্যাশিত মুক্তির খবর বাংলাদেশসহ বিশ্বেরবিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লে ৮ জানুয়ারি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। চারিদিকে সৃষ্টি হয় ব্যাপক সাসপেন্স–ঠিক এ সময় বিশ্বেরবহুল আলোচিত আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স–এর ওপর প্রথম শিরোনামে জানায় বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুররহমান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন।
বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্ন পুরুষ এবং সে সময় বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমানের লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিবিসি টেলিভিন নিয়মিত অনুষ্ঠান স্থগিত করে দিয়েলন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে শেখ মুজিবুর রহমানের অবতরণের খবর লাইভ প্রচার ও বিশেষ বুলেটিন শুরু করে–তাতে দেখা যায়বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গলা খোলা শাদা শার্ট গায়ে এবং ধূসর রঙের স্যুট পরে মুখে পাইপ দেয়া অবস্থায় হাসি মুখেবলছেন-‘আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্দি শিবির থেকে মুক্তি পেয়েরীতিমতো বেঁচে আছি।’ বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিথ্রোবিমানবন্দরে সংবর্ধনা জানানোর জন্য ছুটে এলেন বৃটেনের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও লেবার পার্টির প্রধান হ্যারল্ডউইলসন (পরবর্তিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) এবং বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনের রাজপখে নেমেআসে দলে দলে শহরের অনেক মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই স্বপ্ন পুরুষকে অভ্যর্থনা জানাতে । স্বাধীন বাংলাদেশেররাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বৃটিশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং হিথ্রোবিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতার পর তাকে মটর শোভাযাত্রা করে লন্ডনের বিখ্যাত ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্ল্যারিজেস হোটেলেই অবস্থান করে এবং এখানেবসে ৮ জানুয়ারি তিনি প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। ক্ল্যারিজেস হোটেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওঠার খবরশোনার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনের বাঙালি নারী–পুরুষ হোটেলের সামনে জড়ো হতে থাকে–বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হোটেলেরজানালা থেকে হাত নেড়ে তাদের অভ্যর্থনার জবাব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২–এর ৮ জানুয়ারি লন্ডনেরক্ল্যারিজেস হোটেলে ওঠা সম্পর্কে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিব’ শীর্ষক গ্রন্থে লেখা হয়েছে-‘হোটেল ক্ল্যারিজেসে ঢাকা থেকেটেলিফোন গেল–কথা বললেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মন্ত্রিসভারসদস্যদের সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে কথা বললেন শেখ কামাল, শেখ হাসিনা, রাসেল, শেখ মনি এবং বেগম মুজিব। লক্ষ্যে থেকে শ্রীমতী ইন্দিরাগান্ধি কথা বললেন। দিল্লিতে আসতে আমন্ত্রণ জানালেন। কথা বললেন শেখ আব্দুল আজিজ, আনন্দ বাজার পত্রিকার বার্তাসম্পাদক অমিতাভ চৌধুরীর সঙ্গে। বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকদের সামনে তিনি ইংরেজিতে বিবৃতি পাঠ করে শোনালেন।’ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্দি শিবির থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে লন্ডনের হোটেলে প্রথম সংবাদ সম্মেলনের ভাষণে বাঙালিরস্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু আবেগময় কণ্ঠে প্রথমেই বললেন….
‘জয় বাংলা’ বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপররিসীম এবং অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণাকরেছে–তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন করার জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন পোলান্ড, ফ্রান্স, বৃটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই।বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন-‘স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবসত্য–এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য আবেদন জানাবে।’