১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য যুদ্ধের প্রথম থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কূটনৈতিক ও বস্তুগত (অস্ত্র–গোলাবারুদ–সামরিকরসদ)- উভয়ভাবেই সহায়তা করে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ব্যবহার করে− পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেয়। কিন্তু রাশিয়ার বিরোধিতায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে মিত্রদেশ পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত দেখে ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌ–বহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিতে আদেশ দেন। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে সপ্তম নৌবহরের বেশির ভাগ জাহাজভিয়েতনামের কাছাকাছি ছিল। ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের সবচেয়ে শক্তিশালী ১০টি জাহাজ সিঙ্গাপুরে একত্রিত হয়ে ‘Task force 74’ গঠন করে এবং বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই বহরের নেতৃত্বে দেওয়া হয় সর্বাধুনিক নিউক্লিয়ার বোমাবাহী যুদ্ধজাহাজ USS Enterprise কে।
অন্যদিকে ভারত তাদের গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছে। যা পৌছাতে ৪ থেকে ৫ দিন সময় লাগতে পারে। এই খবরে ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধি রাশিয়ার সামরিক সাহায্য আহবান করেন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধির আহবানে সাড়া দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ান নৌবাহিনী প্রথমধাপে ১৩ ডিসেম্বর নিউক্লিয়ার মিসাইলবাহী দু‘টি ডুবোজাহাজ সহ তিনটি যুদ্ধজাহাজকে ভ্লাডিভস্টক বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করেন। ভারত মহাসাগর এলাকায় আগে থেকেই এই তিনটি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ টহলরত অবস্থায় ছিল। পাশাপাশি পাকিস্তানের মিত্র হিসেবে চীন এই যুদ্ধেজড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সিংকিয়াং সীমান্তেও সৈন্য জমায়েত করে রাশিয়া। সোভিয়াত রাশিয়ার এমন সামরিক হস্তক্ষেপ বুঝতে পেরে চীন এ যুদ্ধে না জড়ানোর ঘোষনা দেয়।
অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধির নির্দেশ পেয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ INS Vikrant বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েন্যাভাল ব্লকেড তৈরী করা হয়।
১৪ ডিসেম্বর আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের জাহাজগুলো মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করে এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের জন্য চূড়ান্তনির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। কারন বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর দেয়া ন্যাভাল ব্লকেড অতিক্রম করতে গেলে পুরাদমে যুদ্ধবেধে যাবে। ১৫ ডিসেম্বর আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া নতুন করে ২০টি রণতরী ভারত মহাসাগরেমোতায়ন করে। সামনে পেছনে সম্মুখ চাপের মুখে এইদিনেই যুক্তরাষ্ট্র তার জাহাজগুলোকে যুদ্ধ থেকে বিরত রেখে নৌ–বহরকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়।
ততক্ষনে দেশের অভ্যন্তরে বাংলার মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর পরিচালিত স্থল–বিমান অভিযানে কোনঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি।
এভাবেই ভারত–রাশিয়ার কূটনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপের কারনে আমেরিকার ৭ম নৌবহরের সামরিক অভিযান থেকে রক্ষা পেয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের সাধারন জনগন।
উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ এর আগস্ট মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি রাশিয়ার সাথে গোপন একটি চুক্তি করে।ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে গোপন এই চুক্তিতে রাশিয়া ভারতকে আশ্বাস দেয় যে, পাকিস্তানের বিপক্ষে চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বাচীন যদি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহন করে তবে রাশিয়া তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সপ্তম নৌবহরে থাকা ‘Task force 74’ জাহাজগুলোর বর্ননা:
USS Enterprise: তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী নৌ জাহাজ। এটি চলতো পারমাণবিক শক্তিতে। জাহাজটিতে ৭৫টি জঙ্গি বিমান ছিল।
F-4 Phantom II ফাইটার: ওই সময় ক্যারিয়ার জাহাজটিতে নিউক্লিয়ার বোমাও ছিল। এটি ছিল টাস্কফোর্স–৭৪এর প্রধান যুদ্ধজাহাজ।
USS Tripoli: এটি একটি উভচর অ্যাসল্ট শিপ। এতে ২০০০ মেরিন সৈন্য ও ২৫টি এ্যাসাল্ট হেলিকপ্টার ছিল।
USS King: গাইডেডে মিসাইলবাহী ডেস্ট্রয়ার
USS Decatur: গাইডেডে মিসাইলবাহী ডেস্ট্রয়ার।
USS Parsons: গাইডেড মিসাইলবাহী ডেস্ট্রয়ার।
USS Bausell (DD-845): গান ডেস্ট্রয়ার।
USS Orleck (DD-886): গান ডেস্ট্রয়ার।
USS McKean (DD-784): গান ডেস্ট্রয়ার।
USS Anderson: গান ডেস্ট্রয়ার।
USS Haleakala (AE-25): সামরিক রসদবাহী জাহাজ এবং একটি নিউক্লিয়ার–এ্যাটাক সাবমেরিন।
সপ্তম নৌ–বহরের ওয়েব এড্রেস http://www.c7f.navy.mil/index.htm
Task force 74 সম্পর্কে জানুন
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Task_Force_74
তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা: নূরুল আজিম রনি, রাগিব আহসান
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের ওয়েবসাইট www.bijoymela.net এ নিয়মিত ভিজিট করুন।