চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম অকৃত্রিম বন্ধু সাইমন ড্রিং। মুক্তিযুদ্ধে যে কজন বিদেশী সাংবাদিক বন্ধু হিসেবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধকালীন ভয়াবহতার কথা তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসবে সাইমন ড্রিংয়ের কথা।
প্রবাদপ্রতিম এই সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন।
দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার ছিলেন সাইমন ড্রিং। তখন করছিলেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। হঠাৎ একদিন লন্ডনের হেড কোয়ার্টার থেকে ফোন করে তাঁকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’
সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিলো না। তাও তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় এলেন। পরদিন ৭ মার্চ ছিলো রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা।
সেই ঐতিহাসিক দিনে তিনি ফুটেজ ও নিয়েছিলেন। অথচ পুরো ভাষণের কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া, তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে অনুভব করলেন, এক বিশাল মোড় নিচ্ছে একটি দেশ ইতিহাসের মহাকালে। “সেদিন মানুষের উদ্দীপ্ত চোখ যেন একেকটা বারুদ। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ইতিহাসের নতুন মোড় নিচ্ছে। ” লিখেছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক নেতা ও জনসাধারণের সাথে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলে বুঝতে পারলেন এই দেশ আজীবন কেবল শাসিত হয়েই আছে। এরা আজীবন অত্যাচারিত হয়েই আছে। তিনি বুঝতেই পারলেন এই অসহায় মানুষেরা এখনো একজনের আঙ্গুলের ইশারায় স্বপ্ন বুনছেন নতুন করে। ভয়ংকর এক ঝড় চলছে মানুষের মনে।
সপ্তাহখানেকের জন্য সাইমন ড্রিং ঢাকা এসে আর ফিরে যেতে পারলেন না তিনি। পাকিস্তানের রাজনীতি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর জানাশোনার পরিধি বাড়লো। বেশ কিছু ব ই পড়লেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। সখ্য গড়ে উঠলো অনেকের সঙ্গে। আর জনগণের মত নিলেন তিনি বারেবারে। রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতেন লন্ডনে।
২৫শে মার্চ রাতে সাইমন ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৫মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের এখানে অবরুদ্ধ করেন। পরে অবরুদ্ধ সকল সাংবাদিককে হোটেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয় যাতে গণহত্যার কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারে বিশ্ব গণমাধ্যম। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক আইন অমান্য করে সাইমন ড্রিং লুকিয়ে পড়েন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তার শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘন্টা সময় কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার, কিচেন প্রভৃতি স্থানে। পরে তিনি ঘুরে ঘুরে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন গণহত্যার বাস্তব চিত্র। পাকিস্তানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে ২৭শে মার্চ “ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান” শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন বিখ্যাত ডেইলি টেলিগ্রাফে । ৩০ মার্চ যা প্রকাশিত হয়। যে রিপোর্ট সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলও। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশাল এক জনমত সৃষ্টি হয় পৃথিবীজুড়ে।
২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে সাইমন ড্রিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ ধানম-ির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি প্রভৃতি স্থান প্রত্যক্ষভাবে ঘুরে দেখেন।
মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। কিন্তু তাকে এয়ারপোর্টে নাজেহাল করা হয়। উলঙ্গ করে চেক করা হয় সাথে কী নিয়ে যাচ্ছেন! তার ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। পায়ের মোজায় কাগজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। এরপর তার পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে তাকে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, পাকিস্তান গেলে তিনি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন না।
কিন্তু কদিন পরেই পাকিস্তান সরকার তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। যদিও তিনি কলকাতায় এসে সেখান থেকে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন পাঠাতেন।
১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।
এমন একজন লোক সাইমন ড্রিং যিনি কেবল সাংবাদিকতার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দাতব্য তহবিল দ্য রেস এসেইন্ট টাইম তাঁর হাতেই গড়া। যেখানে ১৬০টি দেশের সাড়ে ৫ কোটিরও বেশী লোক স্বেচ্ছায় অর্থ দিয়েছেন।
আরেকটি ছিলো “স্পোর্ট এইড” নামের আরকটি তহবিল। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ এ তহবিলে দান করেছিলো। যা ব্যয় করা হয়েছিলো আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য।
অথচ এই কিংবদন্তি কে আমরা অপমান করেছি। মুক্তিযুদ্ধের এই পরম বন্ধুকে আমরা বিএনপি আমলে দেশ থেকে তাড়িয়েছি।
তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশে ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার জনক। সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের ১ম বেসরকারী পর্যায়ের টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে তিনি একুশে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের বেসরকারী টেলিভিশনের আধুনিকতার অন্যতম রূপকার। তাঁর হাতে গড়া একুশে টিভি।
২০০২ সালে একুশে টেলিভিশন সরকারের কথিত কর্তৃপক্ষ সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনজনিত কারণে তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ও তার সহযোগী তিনজন নির্বাহী পরিচালক প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। আদতে যা ছিলো পুরোপুরি ভুয়া!
এরপর ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিএনপি সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দেয়। এর ফলে তিনি ১ অক্টোবর, ২০০২ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তবুও সায়মন ড্রয়িং এদেশের মায়া ভুলেননি। তারপরও বেশ কবার এসেছেন।
সাইমন ড্রিংয়ের স্ত্রী ফিয়োনার কর্মস্থল রোমানিয়া। সাইমন সেখানে নিয়মিত যেতেন। গত ১৬ জুলাই (১৬-৭-২০২১) শুক্রবার সাইমন ড্রিং ৭৬ বছর বয়সে রোমানিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। হার্নিয়া অপারেশনকালে তার মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এই বাংলাদেশ যতোদিন থাকবে ততোদিন আমাদের মনপ্রাণে আপনি থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি বাংলাদেশের অপার বন্ধু সাইমন ড্রিং এর প্রতি।।